তোমার লড়াইকে কুর্নিশ, শতরূপ

নিছকই একটি কাল্পনিক চিঠি। কী জানি, মনে মনে হয়ত এটাই সত্যিকারের চিঠি। জাভেদ খান যদি চিঠি লিখতে পারলেন, তাঁকে যদি বলা হত ভোটের পর শতরূপ ঘোষকে একটা চিঠি লিখতে, তিনি ঠিক কী লিখতেন ? কীভাবে দেখতেন কসবা কেন্দ্রে তরুণ-তুর্কি শতরূপের লড়াইকে ? দমকলমন্ত্রীর বয়ানে সেই চিঠিই লিখলেন প্রসূন বসু ।।

প্রিয় শতরূপ,

চিঠিটা তোমাকে গোপনেই লিখছি। কারণ বিরোধী দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার সংস্কৃতি আমাদের দলে নেই। দিদি নিজে সবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারেন, মোদিকে ফুল পাঠাতে পারেন, বাজপেয়িকে মালপোয়া খাওয়াতে পারেন। কিন্তু অন্য কেউ সে কাজ করলেই, তার গায়ে বেইমানের তকমা লাগিয়ে দেওয়া হবে। তাই গোপনেই লিখছি। (অবশ্য যা দিনকাল পড়েছে। যেভাবে আমাদের সব গোপন কাজ ফাঁস হয়ে যাচ্ছে, তাতে এই চিঠিটাও ফাঁস হয়ে গেলে অবাক হব না।)

বয়সে তুমি আমার থেকে অনেক ছোট। বোধহয় তোমার জন্মের আগে থেকে আমি রাজনীতি করছি। অবশ্য রাজনীতি বলতে তুমি যা বোঝ তাঁর সঙ্গে আমার রাজনীতির তফাত আছে। আমার রাজনীতি মানে আদর্শ, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, ভোটভিক্ষা- এসব নয়। আমার রাজনীতি মানে ক্ষমতা, অর্থের জোর, পেশির জোর। এতদিনের রাজনৈতিক জীবনে একটাই গঠনমূলক কাজ করেছি। আমার দান করা জমিতে তৃণমূল ভবন গঠিত হয়েছে। দলের প্রতি এটা উপহার বা ভেট বলতে পারো। সেই কাজের জন্যই রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছি। অবশ্য নিন্দুকে বলে আমি মন্ত্রী নই, পূর্ব কলকাতার ডন। ভুল কিছু বলে না। আমার এলাকায় আমার এতটাই দাপট যে, বামফ্রন্ট আমলে জলাজমি বুজিয়ে নিজের হোটেল গড়েছি। কেউ কিছু করতে পারেনি।

shatarup ghosh6

বড়বড় হোমরাচোমরারা যা করতে পারল না, তা করবে তোমার মতো পুঁচকে একটা ছোঁড়া! গতবার তুমি যখন আমার বিরুদ্ধে ভোটে দাঁড়ালে, জানতাম অনায়াসে জিতব। হলও তাই। তুমি স্রেফ উড়ে গেলে। তাই এবারের নির্বাচনে আবার তোমাকে প্রতিদ্বন্দ্বী পেয়ে আমার নাকে তেল দিয়ে ঘুমানোর কথা ছিল। কিন্তু ভোট হয়ে যাওয়ার পর ঠিক নিশ্চিত হতে পারছি না। মনে হচ্ছে তোমার জায়গায় অন্য কাউকে প্রতিপক্ষ পেলে আমার লড়াই সহজ হত।

অনেক রাজনীতিবিদ আছেন, যারা একবার হেরে গেলেই পরেরবার নিরাপদ আসনে সরে যান। আমাদের দিদি যেমন। ১৯৮৯ তে যদবপুরে হেরেই ১৯৯১তে দক্ষিন কলকাতায় চলে গেলেন। কিন্তু তোমরা বামপন্থীরা কী ধাতুতে গড়া বল তো? সূর্যকান্ত মিশ্র, সুজন চক্রবর্তী, কান্তি গাঙ্গুলি সবাই হেরে যাওয়া বা পিছিয়ে থাকা আসনে লড়তে নেমেছেন। ওরা না হয় বর্ষীয়াণ নেতা, অনেক লড়াই হেরেছেন, অনেক লড়াই জিতেছেন। কিন্তু তুমি ? রাজনৈতিক জীবনের শুরুতেই পরপর দুটি ভোটে হারলে সেটা কি ভালো দেখাবে?

কিন্তু ভোট প্রচারের সময় দেখলাম, গতবারের হেরো প্রার্থী এবার নতুন অবতারে আবির্ভূত। সে আর পুঁচকে ছেলে নেই। ৫টি বছর তাঁকে অনেক অভিজ্ঞ করেছে, তার মুখ মানুষকে নতুন করে চেনাতে হচ্ছে না। সবথেকে বড় কথা সেই মুখটি মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়েছে। মনে হচ্ছে, আমার মতো বুড়ো বাইসনের থেকে তোমার মতো টাট্টু ঘোড়াকে লোকে পছন্দ করছে বেশি।

অবশ্য এসব পছন্দ-অপছন্দ কীভাবে ম্যানেজ করতে হয় তা আমি জানি। কসবা এলাকায় আমার যা ক্ষমতা তাতে টেনে একটা চড় মারলেই তোমার মতো দশটা প্রতিপক্ষ মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। মুশকিল হল, এবারের ভোটে সেই ক্ষমতা ঠিক মতো দেখানোর সুযোগ পাইনি। ব্যাটা পুলিশগুলো এতদিন সেলাম ঠুকল, কিন্তু ভোটের আগে বেঁকে বসল। আরও মুশকিল হল, সেই ক্ষমতার সামনে দাঁড়িয়ে তুমি বুক চিতিয়ে লড়ে গেছে। এই লড়াইটা যদি ভোটারদের মধ্যে ছড়িয়ে যায় তা হলে কী হবে কে জানে!

আমি ভয় পাচ্ছি শতরূপ। আবার মুগ্ধ হচ্ছি। আমার নামে একজন বিখ্যাত ক্রিকেটার ছিলেন জাভেদ মিয়াদাদ। তাঁর খেলা তুমি দেখেছ কিনা জানি না। আমি দেখেছি। একবার শারজায় ভারতের বিরুদ্ধে ম্যাচে শেষ বলে পাকিস্তানের দরকার ছিল ৫ রান। সবাই ভেবেছিল পাকিস্তান হারবেই। কিন্তু চেতন শর্মার শএষ বলে মিয়াদাদ ৬ মেরে পাকিস্তানকে জিতিয়েছিলেন। এমন শট মারতে সাহস লাগে। বুকের পাটা লাগে। তার এই সাহসকে পাকিস্তানি, ভারতীয় সবাই সেলাম করে।

shatarup ghosh7

জাভেদ মিয়াদাদের সঙ্গে নিজের নামের মিল দেখে মনে মনে অনেক আনন্দ পেয়েছি। কিন্তু আজ দেখছি রাজনীতির ময়দানে আমার মতো পোড়খাওয়া বোলারের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে এক পুঁচকে ছোঁড়া সেদিনের মিয়াদাদের মতোই সপাটে ব্যাট চালিয়েছে। বল আকাশে উঠে গেছে। ছক্কা হবে? নাকি বাউন্ডারির ধারে ক্যাচ ? কেউ জানে না। হয়তো তুমি হারবে। কিন্তু তোমার এই সাহসটাকে সেলাম করি শতরূপ।

জাভেদ খানের বিরুদ্ধে লড়ার জন্য এমন একজন ‘জাভেদ মিয়াদাদকেই’ দরকার।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.