স্বরূপ গোস্বামী
একটা ঘটনা নিয়ে যখন খুব বেশি হইচই হয়, সেই চিৎকারে আশপাশের অনেককিছুই চাপা পড়ে যায়। নিঃশব্দে আরও অনেককিছু ঘটে যায়। কখনও ভাল বিষয়ও চাপা পড়ে যায়। আবার কখনও হয়ত বিতর্কিত জিনিসও সেই হাওয়ায় বিতর্কহীনভাবে পাস হয়ে যায়।
তেমনই ঘটল পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায়। স্বাস্থ্য বিল নিয়ে যখন গোটা রাজ্য উত্তাল, তখনই শিক্ষকদের জন্য রেখে দেওয়া হল মারাত্মক এক অশনি সংকেত। শিক্ষক সমাজ এখনও বিষয়টি নিয়ে উদাসীন। বিরোধীরাও আদৌ খুব সিরিয়াস কিছু ভেবেছেন বলে মনে হয় না। চুপি চুপি শিক্ষকদের বদলির প্রথা চালু হয়ে গেল। বিলটি এমন ভঙ্গিমায় তুলে ধরা হল, যা থেকে মনে হতে পারে, এই বিল হয়ত শিক্ষকদের সহায়ক। মনে হবে, শিক্ষকদের স্বার্থেই এই বিল আনা হল। কী জানি, হয়ত শিক্ষক সমাজ সেটাই ভাবতে শুরু করেছেন। এই বিলের কী খারাপ দিক থাকতে পারে, তা ভেবে দেখাই হল না। বিরোধীদের এত সময় কোথায়?
বলা হল, এতদিন পর্যন্ত শিক্ষকদের নিয়োগকর্তা ছিল স্কুলের ম্যানেজিং কমিটি। স্কুল সার্ভিস কমিশন ইন্টারভিউ ও কাউন্সেলিংয়ের পর ম্যানেজিং কমিটির কাছে পাঠাবেন। ম্যানেজিং কমিটি সেই শিক্ষকদের নিয়োগপত্র দেবে। এবার থেকে নিয়োগ করবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। বদলির ক্ষেত্রে ম্যানেজিং কমিটি অনেক সময় বাধা দেয়। শিক্ষকদের সমস্যা হয়। তাই বদলির ব্যাপারটাও ঠিক করবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ।
আপাতভাবে মনে হল, কী সুন্দর ব্যবস্থা। সত্যিই তো, ম্যানেজিং কমিটির লোকগুলো খুব পাজি। ওদের হাত থেকে রেহাই পাওয়া গেল। সবকিছু কত স্বচ্ছভাবে হবে! হায় রে! কত বড় একটা ফাঁদ যে বিলের আড়ালে রয়ে গেছে, কেউ বুঝতেই পারল না! পুরনো শিক্ষকদের ক্ষেত্রে এটা প্রযোজ্য হলে হয়ত বাধা আসত। কিন্তু নতুন শিক্ষকদের জন্য এই নিয়ম। যাঁরা এখনও যোগদানই করলেন না, তাঁরা বাধা দেবেন কীভাবে? আর পুরনো শিক্ষকরা ভাবলেন, আমাদের তো কোনও ক্ষতি হচ্ছে না। অতএব তাঁরাও উদাসীন থেকে গেলেন।
বদলি ঠিক করবে মধ্যশিক্ষা পর্ষদ। ব্যাপারটা কী সাঙ্ঘাতিক, ভেবে দেখেছেন? মধ্যশিক্ষা পর্ষদ যদি সত্যিই মধ্যশিক্ষা পর্ষদের মতো চলত, তাহলে হয়ত তেমন সমস্যা হত না। কিন্তু প্রতিটি পর্ষদের মাথায় যাঁদের বসানো হয়েছে, তাঁদের পরিচিতিটা একবার মনে করুন। হ্যাঁ, বাম জমানাতেও বাম মনষ্ক অনেক মানুষকে এইসব আসনে বসানো হয়েছে। কিন্তু তাঁরা সরাসরি শিক্ষক সংগঠনের পদাধিকারি ছিলেন না। কোথাও একটা আড়াল ছিল। কিন্তু এখানে প্রাথমিক শিক্ষা সংসদ থেকে স্কুল সার্ভিস কমিশন, চেয়ারম্যান হিসেবে যাঁদের বসানো হয়েছে, তাঁরা তৃণমূলের শিক্ষক সংগঠনের কর্তা। দলের হয়ে কেউ ভোটে লড়েছেন, কেউ মিছিলে হেঁটেছেন। এঁরা কাদের কথায় পরিচালিত হবেন, সেটা বুঝতে পারছেন?
ফল কী হতে পারে? আপনি শাসক দলের সংগঠনে নাম লেখালেন না, বা মিছিলে হাঁটলেন না। তৈরি থাকুন, আপনাকে হয়ত কোচবিহারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। বা কোচবিহারের শিক্ষককে হয়ত পাঠানো হল পশ্চিম মেদিনীপুরে বা পুরুলিয়ায়। হ্যাঁ, বিলে কিন্তু এটা বলা আছে, অন্য জেলাতেও বদলি করা হতে পারে। বেগড়বাই করলেই স্থানীয় তৃণমূল নেতা যেখানে কলকাঠি নাড়ার, নাড়বেন। আপনার কাছে সুন্দরবনে বদলির চিঠি চলে আসবে। আগে কোনও শিক্ষক বদলির আবেদন করলে মিউচুয়াল ট্রান্সফারের ব্যবস্থা ছিল। অর্থাৎ, আপনি না চাইলে বদলি হত না। এখন আপনি চাইছেন না, কিন্তু বদলির ফরমান এসে যাবে। অর্থাৎ, কথা না শুনলেই তৈরি থাকুন। মধ্যশিক্ষা পর্ষদের ছাপানো প্যাডে বদলির চিঠি চলে আসতেই পারে। হুমকি দেওয়ার এমনই এক মোক্ষম অস্ত্র তুলে দেওয়া হল শাসক দলের নেতাদের হাতে।
বিধানসভায় কার্যত বিনা বাধায় এমন মারাত্মক একটা বিল পাস হয়ে গেল। বাধা দেওয়া মানে হই হট্টগোল বা ওয়াক আউট নয়। বিরোধীরা এই দুটো ব্যাপারে খুব পারদর্শী। কী কী বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে, সে ব্যাপারে উপযুক্ত যুক্তি কি সত্যিই তুলে ধরা গিয়েছে? বিষয়টি নিয়ে কোনও আন্দোলন বা ডেপুটেশনের কথা সেভাবে নজরে পড়েনি। গণমাধ্যমে সেভাবে উঠেও আসেনি। এমনকী যে ফেসবুকে প্রতিবাদের বন্যা বয়ে যায়, সেখানকার ওয়ালগুলিও কেমন যেন নীরব। দায়সারা গোছের দু একটি পোস্ট। যাঁরা শিক্ষকতা করছেন, তাঁরা ভাবছেন, আমাদের কোনও ক্ষতি হবে না। যাঁরা পেতে চলেছেন, তাঁরা জানেন না, চাকরি পাবেন কিনা। তাহলে পাল্টা আন্দোলনটা করবেন কারা? রাজনৈতিক দলগুলি হয় বিষয়টার গুরুত্ব সেভাবে বুঝতে পারছে না। অথবা কাদের নিয়ে আন্দোলনটা করবেন, সেটাই বুঝে উঠতে পারছেন না।
বিল পাস হয়ে গিয়েছে। রাজ্যপালের সই হওয়াও সময়ের অপেক্ষা। ভবিষ্যতের শিক্ষকরা টের পাবেন, কী মারাত্মক একটা আইন তাঁদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। কীভাবে তাঁদের পায়ে আনুগত্যের শিকল পরানো হয়েছে। তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে।