ময়ূখ নস্কর
হাঁসুলি বাঁকের উপকথা নিয়ে সিনেমা করেছিলেন তপন সিনহা। সেখানে করালির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন দিলীপ রায়। এক সিনিয়র সাংবাদিকের মুখে শুনেছি, সেই অভিনয় দেখে স্বয়ং তারাশঙ্কর বলেছিলেন, “আমার করালি-টা তোমার জন্যই বেঁচে থাকবে।” পূর্বপশ্চিম নাট্যদলের নতুন নাটক, ‘হাঁসুলি বাঁকের উপকথা’য় কৌশিক করের অভিনয় দেখলে তারাশঙ্কর সম্ভবত একই কথা বলতেন। নির্দেশনায় এবং করালির ভূমিকায় কৌশিক এক কথায় ফাটিয়ে দিয়েছেন।
বাংলা নাটকের উদীয়মান প্রতিভাদের মধ্যে অনির্বাণ ভট্টাচার্যকে নিয়ে যতটা আলোচনা হয়, দুর্ভাগ্যজনকভাবে কৌশিককে নিয়ে ততটা হয় না। দেবী সর্পমস্তায় উদাসের ভূমিকায় অমন অভিনয়ের পরেও অনির্বাণের ভাগ্যেই বেশি প্রশংসা জুটেছিল। কিন্তু হাঁসুলি বাঁকে কৌশিক বুঝিয়ে দিলেন, গৌতম- দেবশঙ্করের পরবর্তী প্রজন্মের ব্যাটন একা অনির্বাণের হাতে নেই। কৌশিক-অনির্বাণ দুজনকেই আগামি দিনে দর্শকদের অনেক প্রত্যাশা পূর্ণ করতে হবে।
হাঁসুলি বাঁকের উপকথার নাট্যরূপ দেওয়ার কথা ভাবতেই যথেষ্ট সাহসের দরকার হয়। উপন্যাস বা বিখ্যাত সাহিত্যের নাট্যরূপ দিতে গিয়ে এর আগে অনেক দলই ধেড়িয়েছে। হাঁসুলি বাঁকের প্রথম শো’র দর্শকরাও অনেকেই ‘দেখি, কদ্দুর কী করতে পারে,’ গোছের মানসিকতা নিয়ে অ্যাকাডেমিতে গেছিলেন। কিন্তু পূর্ব পশ্চিম সসম্মানে সেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। বার বার মনে পড়ছিল বছর ১৫ আগের তিস্তাপারের বৃত্তান্ত নাটকটির কথা। দেবেশ রায়ের ক্লাসিক উপন্যাসভিত্তিক সুমন মুখোপাধ্যায়ের সেই নাটকটি এভাবেই দর্শকদের মুগ্ধ করেছিল।
গোটা নাটকে একমাত্র শেষ দৃশ্যে করালির পরনের গেরুয়া কটিবাস ছাড়া কোনও রং নেই। আগাগোড়া সাদা কালো। এমনকি করালি শহর থেকে পাখির জন্য যে হাল ফ্যাশানের শাড়ি এনে দেয়, সেটাও কালোর ওপরে সাদা পোলকা ডট। শোষিত, বঞ্চিত কাহার সমাজের দলাদলি, হিংসা, পরকীয়া, কুসংস্কার, প্রাণোচ্ছলতার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে খাপ খেয়ে যায় এই সাদা কালো।
এই রংহীন আবছায়ায় পরকীয়ায় মাতে বানোয়ারি আর কালো বউ। প্রথমে কত্তাবাবার থানে, পরে কোপাইয়ের তীরে। অন্য সব দৃশ্যের মধ্যে এই দৃশ্যটির কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করতেই হল। কারণ, নাটকের এই দৃশ্যে মূল উপন্যাসকে অনুসরণ করা হয়নি। যদিও তাতে উপন্যাসের কোনও অমর্যাদা হয়নি। বরং মনে হয়, মঞ্চে এই নাটকীয়তারই প্রয়োজন ছিল।
আর উল্লেখ করতে হয়, হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার দৃশ্যটি। তারাশঙ্করের লেখায় এমন কোনও ঘটনা নেই। কিন্তু নাটকে দেখা যায়, কোট-প্যান্ট-হ্যাট পরা করালি বাঁশি বাজাতে বাজাতে শহরের দিকে চলেছে। আর তার পিছু পিছু মন্ত্রমুগ্ধের মতো চলেছে কাহার যুবকরা। সামন্ততন্ত্র ভেঙে ধনতন্ত্র আসছে। গ্রাম উঠে যাচ্ছে শহরে। বংশীবাদক কৌশিকের শরীরী অভিনয় প্রশংসনীয়। প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন, বানোয়ারি, কালো বউ, নসু এবং অবশ্যই বুড়ি সুচাঁদের ভূমিকায় সুরঞ্জনা দাসগুপ্ত।
উপন্যাসে বুড়ি সুচাঁদ বলেছিল, ‘যা হিয়ের জিনিস তাকে হিয়েতেই রাখতে হয়।‘ বাংলা নাটকের দর্শক হাঁসুলি বাঁকের উপকথাকে হিয়েতে রাখবে বলেই বিশ্বাস।