ড. সুশোভন মণ্ডল
এমন বাঙালি খুব কমই আছেন, যাঁরা একটা বয়সের পর হাঁটুর ব্যথায় ভোগেন না। রাস্তায় চললেই দেখতে পাবেন, কেউ খুঁড়িয়ে হাঁটছেন, কেউ লেংচে, কেউ লাঠিতে ভর দিয়ে। আবার কেউ চলেছেন রিকশায়, কারণ তাঁর হয়ত হাঁটার মতো হাঁটুর অবস্থাই নেই। হাঁটা আর হাঁটু- এই দুটো শব্দের মধ্যে অদ্ভুত একটা মিল। শব্দ দুটির উৎপত্তির ব্যকরণ ঠিক জানা নেই। কিন্তু শব্দ দুটোকে দেখলেই বোঝা যায়, একে অপরের উপর নির্ভরশীল। অর্থাৎ, হাঁটু ভাল থাকলে তবেই আপনি হাঁটতে পারবেন।
কিন্তু হাঁটুর ব্যথা হয় কেন ? নির্দিষ্ট একটি নয়, অনেকগুলো কারণ আছে। বয়সের ক্ষয়জনিত কারণে হাঁটুর ব্যথা হতে পারে। শরীরে হয়ত অন্য রোগ আছে, তার কারণেও হতে পারে। যেমন ধরুন, রিউম্যাটয়েড আর্থারাইটিস বা অ্যানকাইলোসিং স্পন্ডলাইটিস এই ধরনের কঠিন কঠিন উচ্চারণের বাত থাকলে তার থেকে হাঁটুতে ক্ষয় হয়ে ব্যথা হতে পারে। কিন্তু সবার তো এই ধরনের কঠিন কঠিন বাত নেই। কিন্তু তাও হাঁটুতে ব্যথা হয়। তার কারণ, বয়সের ক্ষয়জনিত কারণের ফলে তৈরি হওয়া অস্টিও আর্থারাইটিস। হাঁটু জিনিসটা বাইরে থেকে একটা পাটকেলের মতো দেখতে লাগলেও ভেতরটা কিন্তু যথেষ্ট রহস্যময় বা কমপ্লেক্স। এর ভেতরে একটা তরল পদার্থ থাকে, যা গাড়ির মোবিলের মতো কাজ করে। একে বলে সাইনোভিয়াল ফ্লুইড। আর এই ফ্লুইডটা একটা পর্দার তৈরি থলির মধ্যে থাকে যাকে বলে সাইনোভিয়াল মেমব্রেন। তার মানে থলির মধ্যে দুটো হাড়ের বা অস্থির সংযোগস্থল আর তার চারপাশে মোবিল। এছাড়াও এর মধ্যে মাংসপেশীর টেন্ডনগুলো ঢুকে থাকে। এই টেন্ডন দিয়ে একটা মাংসপেশী হাড়ের সঙ্গে যুক্ত হয়। এছাড়াও এর মধ্যে শক্ত দড়ির মতো লিগামেনট বলে একটা জিনিস থাকে। যেটার মাধ্যমে দুটো হাড় একে অপরের সঙ্গে যুক্ত থাকে। সুতরাং, প্রথমে যে কথাটা বলেছিলাম, সেটাই এখন টের পাচ্ছেন যে ভেততরটা বেশ রহস্যময় বা কমপ্লেক্স।
অস্টিও আর্থারাইটিস রোগটি যে শুধু হাঁটুতে হয়, এমন নয়। দেহের অন্যান্য জয়েন্টেও হতে পারে। যেমন আঙুল বা কোমরের জয়েন্টে। যেহেতু আমাদের আলোচনার বিষয় হাঁটু, তাই হাঁটুর অস্টিও আর্থারাইটিস নিয়েই আলোচনা করছি। এই রোগটি সন্ধিস্থলে বা জয়েন্টে যে যে জিনিসগুলি সম্পর্কে আগে বললাম, যেমন সাইনোভিয়াল ফ্লুইড, মেমব্রেন, অস্থি ইত্যাদি সবকিছুকে ধরে ফেলে। অস্থিগুলোর ক্ষয় হয়। আর সেই ক্ষয়পূরণের জন্য নতুন হাড় তৈরি হয়। কিন্তু সেই নতুন হাড় কি আর আগের মতো সেট হয় ? হয় না। ফলে, জয়েন্টের চারপাশে হাড়ের কুচি তৈরি হয়, যেগুলোকে এক্স রে তে বেশ ভালভাবেই দেখা যায়। এর পোশাকি নাম অস্টিওফাইট। এরা কিন্তু অস্টিও আর্থারাইটিসের বেদনার উৎস। এখন অবশ্য অস্টিও ফাইট নিয়ে বেশি ফাইট না করাই ভাল। অন্য প্রসঙ্গে আসি।
কাদের অস্টিও আর্থারাইটিস হতে পারে? যাদের ওজন বেশি। অর্থাৎ, যত মোটা হবেন, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তত এই রোগটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। সুতরাং যথাসম্ভব রোগা থাকুন আর নীরোগ হন। মহিলাদের ক্ষেত্রে এটি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এর থেকে তো মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা নেই (যদি না একান্তই অস্টিও আর্থারাইটিসের ভয়ে সেক্স চেঞ্জ করে বসেন)। আর কী কারণে এটা হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায় ? ধূমপান না করলে। হ্যাঁ, আপনি ঠিকই পড়ছেন। ধূমপান না করলে। এই কথা শোনার পর যেন আবার ধূমপান শুরু করে দেবেন না। কারণ, ধূমপান শুরু করলে অন্যান্য অসুখের যা ফিরিস্তি দাঁড়াবে, তা গুণে শেষ করা যাবে না। তবে যাই বলুন, যাঁরা ধূমপান করেন, তাঁরা ধূমপানের পক্ষে অন্তত একটা যুক্তি তো পেলেন। এটাই বা কম কী ?
আচ্ছা, এই ধরনের রোগ হলে তার লক্ষণ কী ? আসলে, এর লক্ষণ প্রকাশ পেতে পেতে বহু বছর লেগে যেতে পারে। মানে, শরীরের মধ্যে এই অসুখ সৃষ্টি ও তার বাহ্যিক প্রকাশের মধ্যে বহু বছরের ব্যবধান থাকতে পারে। অস্টিও আর্থারাইটিসের প্রধান লক্ষণ ব্যথা। একটু হাঁটলেই হাঁটুতে ব্যথা। সিঁড়িতে উঠতে গেলে ব্যথা। ভারতীয় পায়খানায় বসতে গেলে ব্যথা। রিকশায় উঠলে ব্যথা। এমনকি রাতে শুতে গেলেও স্বস্তি নেই। তখনও ব্যথা। হাঁটুতে চাপ দিলে ব্যথা হয়। আর এই ব্যথার জন্য মানুষ বেশি হাঁটে না। দৌড়য় না। ফলে, হাঁটু সংলগ্ন থাইয়ের মাংসপেশীগুলো রোগা হয়ে যায় আর অকেজো হয়ে পড়ে।
প্রশ্ন হল, ওষুধ ছাড়াও আপনারা বাড়িতে কী করে ভাল থাকতে পারেন ? অস্টিও আর্থারাইটিসে আক্রান্ত হলে দৈনন্দিন জীবনে কিছু বিধি নিষেধ আরোপ করতে হবে। যেমন ভারতীয় পায়খানার বদলে ওয়েস্টার্ন বা কমোড ব্যবহার করতে হবে। নিচু জায়গায় না বসাই ভাল। যতটা সম্ভব হাঁটু ভাঁজ না করার চেষ্টা করুন। যেখানে গেলে হাঁটু ভাঁজ করে থাকতে হবে, সেসব জায়গা পারলে এড়িয়ে চলুন। অস্টিও আর্থারাইটিস খুব বেশি মাত্রায় গ্রাস করলে ওয়াকিং স্টিকের সাহায্য নিতে পারেন। আর যখন অস্টিও আর্থারাইটিস সবে আক্রমণ করছে, তখন থাইয়ের মাংসপেশীগুলি আরও জোরদার করার জন্য ব্যয়াম করতে হবে।
ওষুধের কচকচানিতে না ঢোকাই ভাল। আপনার ডাক্তারবাবু সেটা ভাল বুঝবেন। তবে মাথা ব্যথার ওষুধ বা বাজার চলতি পেইন কিলার খাবেন না। কারণ, তাতে ব্যথা কিছুটা কমলেও অন্য পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার আশঙ্কা আছে, যা থেকে পরে কিডনি খারাপ করে দিতে পারে। পাকলস্থলিতে রক্তক্ষরণের সম্ভাবনাও থাকে। খুব ব্যথা হলে প্যারাসিটামল এক গ্রাম খেয়ে নিতে পারেন। কন্ড্রোইটিন ও গ্লুকোস্যামিন নামক মলিকিউল বর্তমানে ওষুধ হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে যা রোগের উন্নতি ঘটায়। এছাড়া জয়েন্টে স্টেরয়েড ইঞ্জেকশনের ব্যবস্থা আছে। তাছাড়া আগে যে সাইনোভিয়াল ফ্লুইডের কথা বলেছি, যে ফ্লুইডের বিকল্প হিসেবে ভিস্কো সাপ্লিমেন্টেশনের ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও অস্টিও আর্থারাইটিসের রোগীদের ভিটামিন ডি-এর অভাব থাকার কথা নয়। আর সবশেষে আছে জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট। অর্থাৎ, পুরনোকে বাতিল করে নতুন জয়েন্ট লাগানো। সাধারণত জয়েন্টের অবস্থা একেবারে শেষপর্যায়ে পৌঁছে গেলে এং বয়স ৬০-এর আশেপাশে হলে জয়েন্ট রিপ্লেসমেন্ট করলে তার ফল সবথেকে ভাল হয়।
আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অনেককিছুর মতোই অস্টিও আর্থারাইটিস নিয়েও ভ্রান্ত ধারণা আছে। যেমন, অমাবশ্যা-পূর্ণিমায় ব্যথা বাড়া-কমা। এগুলোর কোনও বৈজ্ঞানিক ভিত্তিই নেই। এক্ষেত্রে মানসিক ভূমিকাই বেশি। ব্যথা একজন কতটা অনুভব করবেন, তা কিন্তু তাঁর মানসিক অবস্থার উপরেও অনেকটাই নির্ভর করে। এছাড়াও বলা উচিত, বিভিন্ন অবৈজ্ঞানিক ব্যথার স্পেশালিস্টের পাল্লায় পড়বেন না। তাহলে কিন্তু আপনার হাঁটুর সঙ্গে সঙ্গে ব্যাঙ্কের চেকবইয়েরও ক্ষতি হয়ে যাবে।
(লেখক একজন বিশিষ্ট অস্থি চিকিৎসক।)