২০০৯ এর ৮ জুলাই। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর ৯৫ তম জন্মদিনে তৎকালীন ক্রীড়া ও পরিবহন মন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তীর বক্তৃতাটা এখনও ভীষণভাবে তাৎপর্যপূর্ণ তাঁর কাছে। নিজের আপাত দৃঢ় মনস্ক স্বামী’র সেদিন আবেগতাড়িত হয়ে কান্নার মধ্যেই যেন দেখতে পেয়েছিলেন ঘনিয়ে আসা যন্ত্রনার দিনগুলো, সেই মুহুর্তটা আজ আরও বেশি করে মনে পড়ছে রমলা চক্রবর্তীর।
৮ জুলাই বরাবরই তাঁর কাছে অন্যরকম দিন। এই দিনে পথের পাঁচালির উদ্যোগে প্রতিবার পালিত হয়ে আসছে জ্যোতি বসুর জন্মদিন। যাঁর মূল উদ্যোক্তা ছিলেন সুভাষ-রমলা জুটি। তিনি প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী’র কতটা স্নেহধন্যা ছিলেন, কতটা নিবিড় যোগাযোগ ছিল সুভাষ চক্রবর্তী ও জ্যোতি বসুর পরিবারের মধ্যে তা কার না জানা ? আজ জ্যোতি বসুর জন্মদিনে সেই রমলা চক্রবর্তী’র সঙ্গেই ডাউন মেমোরি লেনে হাঁটলেন বেঙ্গলটাইমসের প্রতিনিধি মৌতান ঘোষাল……
প্রশ্নঃ জ্যোতি বসুর রোজকার খাওয়ার তত্বাবধানের দায়িত্ব তো একরকম আপনারই ছিল, আপনার হাতের রান্নার নাকি খুব প্রশংসা করতেন তিনি ?
রমলাঃ আসলে ৯২ সালে যখন জ্যোতি বাবুরা ইন্দিরা ভবনে থাকতে এলেন তখন ওনার কাজের দায়িত্বে থাকা ছেলেটির হঠাৎ মা মারা যায়। আর তার ক’দিন আগেই বৌদি’র পা ভেঙে যায়। আমরা তখন থাকতাম লেকটাউন পাতিপুকুরের কাছে। বৌদি’র সঙ্গে আমার খুবই ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। কাজেই আমি তখনই পাতিপুকুর থেকেই রান্না করে পাঠাতে শুরু করলাম। প্রায় দেড় মাস। এরপর আমিও চলে আসি সল্টলেকে। বাড়িটাও কাছাকাছি হয়ে যায়। তাই নিয়মটা থেকেই যায়। বাড়িতে ভাল কিছু রান্না হলেই তোমাদের সুভাষদা বলতেন জ্যোতি বাবু’র বাড়িতে পাঠিয়েছ ? আমারও মনে হয়েছিল ওনার মতো একজন গুরত্বপূর্ণ মানুষের খাওয়ার দিকটা, সুস্থ থাকার দিকটায় একটু নজর থাকা ভাল। উনি মজা করে বলতেন ‘তুমি তো সুভাষকে আর আমাকে রুগীর ঝোল খাওয়াও’। আমি বলতাম, তাঁর জন্যই আপনি এখনও সুস্থ আছেন।
যেদিন নেলশন ম্যান্ডেলা এসেছিলেন কলকাতায়, সেদিন আমার বাবা দেখতে গেলেন সেই স্বপ্নের মানুষটাকে। রাস্তায় জ্যোতি বসুর সঙ্গে আলাপ হতে তিনি আমার বাবাকে বললেন ‘আমি তো রোজ আপনার মেয়ের হাতের রান্না খাচ্ছি।
প্রশ্নঃ এত কাছ থেকে দেখেছেন জ্যোতি বসুকে। রাজনীতির বাইরে কেমন ছিলেন জ্যোতিবাবু?
রমলাঃ রাজনীতিবিদ হিসাবে যতটা রাশভারী মানুষ ছিলেন তিনি ব্যক্তিগত জীবনে কিন্তু একেবারেই তা ছিলেন না। বাইরে থেকে যতটা কঠিন মনে হত, ভেতরটা ঠিক ততটাই নরম। নাতি-নাতনিদের কাছে একজন স্নেহশীল দাদু, বাকিদের কাছে স্নেহশীল অভিভাবক। মিশলে বোঝা যেত তিনিও একজন সাধারণ মানুষই ছিলেন। যে মানুষ পরিবারের ঘনিষ্ট জনদের সঙ্গে ঠাট্টা ইয়ার্কিও করতেন। অবশ্যই তা হত যথেষ্ট উইটি। খুব ব্যস্ততা না থাকলে নাতির সঙ্গে প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই দেখা করতে যেতেন। আর ওনার শরীর ভেঙ্গে যাওয়ার পর নাতি আসত ওঁর কাছে। দুজনের একটা নিবিড় যোগাযোগ ছিল। আর নাতনিদের আধুনিক বেশভূষা নিয়েও বেশ মজার মজার কথা বলতেন। তিনি সংসারিও নন, কিন্তু সন্যাসীও ছিলেন না।
প্রশ্নঃ আপনার স্বামী, মানে সুভাষ চক্রবর্তীর সঙ্গে রাজনৈতিক মতবিরোধ ঘটলে কখনও কি আপনার উপর দায়িত্ব পড়েছে সুভাষদাকে কিছু বোঝানোর?
রমলাঃ প্রথমত জ্যোতি বাবু’র সঙ্গে সুভাষের মতপার্থক্য খুব একটা কখনও হয়নি। উনি বরং সুভাষের স্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত থাকতেন। বারবারই আমাকে সেদিকে নজর দিতে বলতেন। সুভাষদা খেতে খুব ভালোবাসতেন। সুগার ধরা পরার পর ওঁকে বেশি খেতে বারন করতেন। উদ্বিগ্ন থাকতেন সুভাষকে নিয়ে। একজন অভিভাবক যেমনভাবে আগলে রাখেন, ঠিক সেই রকম।
প্রশ্নঃ আজ যখন সেই ইন্দিরা ভবনের সামনে দিয়ে যান কতটা নস্ট্যালজিক লাগে ? পুরানো দিনগুলো মনে পড়ে ?
রমলাঃ মনে হয় ইন্দিরা ভবনের বোবা পাথরগুলোও অনেক কথা বলতে চায়। ইন্দিরা ভবনে চেয়েছিলাম জ্যোতি বাবু’র একটা সংগ্রহশালা হোক। কিন্তু তা করতে দিল না। জ্যোতি বসু’কে নিয়ে রিসার্চের জন্য যে জায়গাটার জন্য টাকা দেওয়া ছিল, সেটাও তো দিচ্ছে না! যাক এভাবে কি আর জ্যোতি বসুকে মুছে দেওয়া যায়? যাবে না।
প্রশ্নঃ জ্যোতিবাবু’র জন্মদিন পালন শুরুও তো আপনি, মানে আপনার সংস্থা ‘পথের পাঁচালি’ই করতো? উনি এই বিষয়টা কতটা উপভোগ করতেন ?
রমলাঃ আমাদের পার্টি’তে জন্মদিন পালনের রীতি ছিল না। একমাত্র আমাদের পার্টি’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মুজফফর আহমেদ, মানে ‘কাকাবাবু’র জন্মদিনই পালন করা হত উনি বেঁচে থাকতেই। আর কারুর নয়। তবে আমি নয়, সুভাষদা’র আগ্রহেই জ্যোতিবাবু’র জন্মদিল পালন শুরু হয়। কিন্তু মন্ত্রী ও পার্টি’র অন্যতম নেতা হওয়ায় ওঁর পক্ষে সরাসরি এটা করা সম্ভব ছিল না। তাই পথের পাচালি’র উদ্যোগে এটা শুরু হয়। জ্যোতিবাবু প্রথমে রাজি ছিলেন না। এই বয়সে জন্মদিন পালন করতে। আমি আর সুভাষদাই জোর করি, বোঝাই তিনি মুখ্যমন্ত্রী। সেই সঙ্গে একজন জীবন্ত কিংবদন্তি। তাঁর জন্মদিন জনগণ পালন করতে চায়। তখন একরকম নিমরাজি হন। আর আমরা সেটুকুকেই অনুমতি ধরে নিয়ে দিনটা পালন করতে শুরু করি। সেদিনটা তিনি আম জনতার। বিভিন্ন স্কুল থেকে অনেক ছোট ছোট ছেলেমেয়ে আসত। তিনি বাচ্চাদের খুব ভালবাসতেন। তাদের সঙ্গে কথা বলতেন। দিনটা বেশ উপভোগ করতেন। প্রথমে পার্টি বিষয়টায় দূরত্ব বজায় রাখলেও পরে জনগণের উৎসাহ দেখে আলিমুদ্দিন থেকেও ফুল পাঠাতে শুরু করে। বলতে পারো একটা আগল ভেঙেছিলাম। ২০০৯-এ তাঁর জীবিত অবস্থার শেষ জন্মদিন্টা আজও মনে আছে আমার!
প্রশ্নঃ কী হয়েছিল সেদিন ?
রমলাঃ সুভাষ সেদিন ওঁর জন্মদিনের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে এসে আবেগে, কান্নায় ভেঙে পড়েন। তখন জ্যোতি বাবু’র শরীর খুব খারাপ। সুভাষেরও ক্যান্সার ধরা পড়েছে। হয়তো ও বুঝতে পেরেছিল আর বেশিদিন এই দিনটা এভাবে পালন করা যাবে না! এরপরেই তো সুভাষ চলে গেল ২০০৯ এই, আর তারপরই ২০১০ এ চলে গেলেন জ্যোতিবাবু। এই দু’বছরেই এই দুটো ধাক্কাতেই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছি। আর ক্ষতিটা যে কতটা তা তো আজ সবাই জানে।
প্রশ্নঃ একবার ওঁর জন্মদিনে ওঁকে একটা ওঁরই মোমের মুর্তি দেওয়া হয়েছিল না ?
রমলাঃ সে এক কান্ড! এই যে আজকাল মোমের মুর্তি’র মিউজিয়াম হচ্ছে, এটা কিন্তু সুভাষেরই ভাবনা ছিল একসময়। ওই মুর্তি বইমেলায় আমাদের প্যাভিলিয়নে রাখতে গিয়ে কম সমস্যায় পড়তে হয়নি। কথা ছিল মুর্তি’র বুকে একটা পেন রেখে মুর্তি’র উদ্বোধন করবেন জ্যোতি বাবু। মুর্তি দেখেই বললেন ’আরে এতো আমিই’! আর সেদিন প্রতিম চট্টোপাধ্যায় আর কলিমুদ্দিন সামস জ্যোতি বা্বু’কে ফুল দিতে এসে মুর্তিকেই তা দিয়ে ফেলেন। সে এক মজার ঘটনা!
প্রশ্নঃ জন্ম শতবর্ষে তো তেমন কিছু হল না।
রমলাঃ একেবারে হয়নি, তা নয়। দলের পক্ষ থেকে অনেক কর্মসূচিই নেওয়া হয়েছিল। জ্যোতি বসু জন্ম শতবর্ষ উদযাপন কমিটি হয়েছে। তারাও অনেককিছু করেছে। তবে সরকারি উদ্যোগে অনেক কিছু হওয়া উচিত ছিল। সরকার যদি উদাসীন থাকে, কী আর করা যাবে ? এভাবে জ্যোতি বসুকে মুছে ফেলা যাবে না। জ্যোতি বাবু যে বাড়িতে থাকতেন, সেই বাড়ির নাম ইন্দিরা ভবন। অন্য দলের এক প্রয়াত প্রধানমন্ত্রীর নামাঙ্কিত বাড়িতে থাকতে তাঁর কোনও সংকোচ হয়নি। তিনি যে শহরে থাকতেন, তার নাম বিধান নগর। তিনিই এই নামকরণ করেছিলেন। অতীতকে শ্রদ্ধা জানাতে হয়। এটাই পরম্পরা। উনি সেই পরম্পরা মানতেন। আর আজ তাঁর নামে তৈরি নগরী থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলা হল। তাঁর নামে গবেষণা কেন্দ্র নিয়ে টালবাহনা হচ্ছে। তবু জ্যোতি বসু বেঁচে থাকবেন। লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী মানুষের হৃদয় থেকে তাঁর নাম মুছে ফেলা যাবে না।