সরল বিশ্বাস
আড়াই দশক আগে শোনা একটা গান। ‘বৃষ্টি থামার শেষে, সোনালী আলোয় ভেসে’। সেদিনও শহরজুড়ে বৃষ্টি নেমেছিল। গুড়ি গুড়ি সেই বৃষ্টির পর একটু একটু করে সন্ধ্যেও নেমে এল। তারপর সত্যিই সোনালী আলোয় ভেসে যাওয়া।
অনুষ্ঠানের নাম ‘শচীন সুরে সোনালী’। শচীন কে, বলে দেওয়ার অপেক্ষা রাখে না। নিশ্চয় কেউ শচীন তেন্ডুলকার ভাবছেন না। যাঁরা সুরের খোঁজ রাখেন, তাঁদের কাছে শচীন মানে শচীন কর্তা। আর সোনালী মানে, সোনালী রায়। তিনিও আধুনিক বাংলা গানের জগতে মোটামুটি পরিচিত নাম। যেমন পরিচিত নাম, তেমনি পরিচিত মুখও। কারণ, টিভির নানা অনুষ্ঠানে প্রায়ই দেখা যায় এই সুগায়িকাকে।
রবি ঠাকুরের গানে তিনি কতটা পারদর্শী, সে ‘সকালের রবীন্দ্রনাথ’ যাঁরা শোনেন, তাঁদের অজানা নয়। বছরের পর বছর প্রায় একার কাঁধে অনুষ্ঠানটিকে টেনে নিয়ে গেছেন। আধুনিক গানের গলাটা কেমন, তা যাঁরা তাঁর অ্যালবামগুলি শুনেছেন, তাঁরা বেশ ভালই জানেন। তালিমটা শুরুই হয়েছিল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত দিয়ে। নজরুল থেকে দ্বিজেন্দ্রলাল, অতুলপ্রসাদ থেকে রামপ্রসাদ, সবেতেই সাবলীল। একটার সঙ্গে আরেকটার অনেক ফারাক। কিন্তু তিনি যে শচীনকর্তাকেও এভাবে হৃদয়ঙ্গম করেছেন, তা সেই সন্ধ্যায় হাজির না থাকলে অজানাই থেকে যেত।
অনুষ্ঠান তো নয়, যেন চাঁদের হাট। সৌগত রায় থেকে কল্যাণী কাজী। কল্যাণ সেন বরাট থেকে কৃষ্ণকিশোর মুখার্জি, শীতের পরে বসন্তের মতো জগন্নাথ বসু, উর্মিমালা বসু, তালিকাটা বেশ লম্বা। বোঝা গেল, সোনালীর গান,তাঁর বৈচিত্র্য অনেককেই ছুঁয়ে গেছে। শুরুতে প্রকাশিত একটি ভক্তিগীতির অ্যালবাম। নাম কালী কল্পতরু। সঙ্গীতায়োজনে কল্যাণ সেন বরাট, ভাষ্যপাঠে জগন্নাথ বসু। আর গানে! অবশ্যই সোনালী।
সে অন্য কথা। শচীন কর্তার কথায় আসা যাক। কারণ, অনুষ্ঠানটা তো শুধু শচীন কর্তাকে নিয়েই। শুরু হল বাংলা দিয়ে, তারপর হিন্দি। গোটা পাঁচেক বাংলা (বর্ণে গন্ধে হৃদয়ে গীতিতে, তুমি আর নেই সে তুমি, কে যাস রে, বাঁশি শুনে আর কাজ নাই, টাকডুম টাকডুম বাজাই)। তারপর প্রায় একডজন হিন্দি। তার মধ্যে রঙ্গিলা রে, ম্যায়নে কাহা ফুলোসে’র মতো মনমাতান গান যেমন আছে, তেমনি ‘রুলাকে গ্যায়া স্বপনা’, ‘ওয়াক্ত নে কিয়া’র মতো মর্মস্পর্শী গানও আছে। শচীন কর্তার নানা আঙ্গিকের গানকেই সুন্দরভাবে ছুঁয়ে গেছেন এই শিল্পী।
গীতা দত্ত বা লতা মঙ্গেশকারের কণ্ঠে যেগুলো আমরা শুনে অভ্যস্থ, সোনালীর কণ্ঠে তা একেবারেই বেমানান মনে হল না। অল্প সময়ের মধ্যে এরকম একটা অনুষ্ঠানের প্রস্তুতি, তার উপর এমন বৈচিত্র্যপূর্ণ গানকে বেছে নেওয়া। হ্যাঁ, অনেকটাই ঝুঁকি নিয়েছেন। সন্ধ্যা শেষে বলতেই হয়, অনেকটাই সফল।
তবে একটা আক্ষেপ। শচীন কর্তার শুধু মহিলা কণ্ঠের গান কেন ? অভিমান বা মিলির গান ছিল। কিন্তু কিশোরের কণ্ঠে ‘বড়ি শুনি শুনি হ্যায়’ বা ‘আয়ে তুম ইয়াদ মুঝে’র মতো হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া গান বা রফি, মুকেশের কণ্ঠে এস ডি-র কালজয়ী দু একটা গান থাকলে মন্দ হত না। সোনালির দরদী কণ্ঠে সেই গান বেমানান হত বলে মনেও হয় না। বৃষ্টিভেজা সেই সন্ধ্যায় আমরাও না হয় একটু কাঁদতাম। শ্রদ্ধার্ঘ্য যখন সেই কিংবদন্তিকে, তখন তা আরও পূর্ণাঙ্গ চেহারায় হলেই পূর্ণতা পেত।
আসলে, বলা সহজ। কিন্তু এত অল্প সময়ে, একটা সন্ধ্যায় সবকিছু তুলে ধরা সম্ভবও নয়। যা পাওয়া গেছে, সেটাই বা কম কী ? সঙ্গীতায়োজনে দেবজিৎ রায় ও সহশিল্পীদের তারিফ করতেই হবে। আরেকজনের কথা না বললেই নয়।সঞ্চালক দেবাশিস বসু। শচীনকর্তার অনেক অজানা কথা তো উঠে এলই, অনুষ্ঠানের মাঝে অন্য মাত্রাও নিয়ে এলেন। সবমিলিয়ে, এক মনোরম সন্ধ্যা। প্রত্যাশা অনেকটাই বাড়িয়ে দিলেন সোনালী।