১৩ বছর আগে শেষবারে জাতীয় লিগ এসেছিল বাগানে। আজকের তারকারা সেদিন ঠিক কোন ভূমিকায় ছিলেন। কেউ কোচের হাতে ফুল তুলে দিয়েছিলেন, কেউ ছিলেন টি এফ এ-তে, কারও আবার মনেও নেই। ১৩ বছর আগের সেই দিনটাকে ধরতে চাইলেন মৌতান ঘোষাল।।
২০০২-এ মোহনবাগানকে জাতীয় লিগ চ্যাম্পিয়ন করে ফেরার পরদিন যখন মাঠে এলেন মোহনবাগান কোচ সুব্রত ভট্টাচার্য, তখন তাঁর হাতে গোলাপের তোড়া তুলে দিয়েছিল এক ঝাঁক খুদে ফুটবলার। বাগানের অনূর্ধ্ব-১৩ দল। সেই ফুটবলারদের দলে ছিলেন সৌভিক চক্রবর্তীও । হ্যাঁ, সদ্য আই লিগ জয়ী মোহনবাগান দলের সফল মিডফিল্ডার সৌভিক চক্রবর্তী। সে’বছরই বাগানের অনূর্ধ-১৩ দলে প্রথম খেলতে এসেছিল ১২ বছরের সৌভিক।
বেঙ্গালুরুতে চ্যাম্পিয়ন হওয়া, ঘরে ফেরা, বিমানবন্দর থেকে ক্লাব পর্যন্ত সমর্থকদের ভালোবাসার অত্যাচার, আর তারপর টিভি চ্যানেলের প্যানেল ডিসকাশন, সবকিছুই যেন একটা ঘোরের মধ্যে হয়ে যাচ্ছিল! কিছু ভাবার সময়ই ছিল না। কিন্তু বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে সিলিং এ আঁটা রেডিয়াম স্টিকারের চাঁদ তারাগুলোর দিকে তাকিয়ে সৌভিকের হঠাৎই মনে পড়ে সেই দিনটার কথা। কত ছোট তখন! ছোটবেলায় তাঁর ঘরের সিলিংয়ে লাগানো এই স্টিকারগুলোই চাঁদ-তারাদের স্বপ্নের রাজ্যে নিয়ে যেত ছোট্ট সৌভিককে। আর আজ সৌভিক নিজে বাংলার ফুটবল জগতের একজন উজ্জ্বল তারকা।
শেষবার বাগানে জাতীয় লিগ ঢোকার উন্মাদনার কোনও ধারনাই নেই শিলটন পালেরও। কারণ, তখন শিলটন টিএফএ-র হোস্টেলে। বাবা ছিলেন ইংল্যন্ডের গোলকিপার পিটার শিলটনের ভক্ত। ছেলের জন্মের সঙ্গেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন ছেলেকে ফুটবলার বানাবেন আর গোলকিপারই বানাবেন। তাই ছেলের নাম রাখেন শিলটন। বাবার সেই স্বপ্নপূরণ করতে টাটা ফুটবল অ্যাকাডেমিতে তখন চলছিল চুটিয়ে ফুটবল আর পড়াশোনা। আজ বাবার স্বপ্নপূরণ করেছেন আই লিগ জয়ী মোহনবাগান অধিনায়ক শিলটন পাল।
পঙ্কজ মৌলা, রাম মালিকরাও তখন নিজের নিজের জেলায় স্কুলের ছাত্র। আর এবারের লিগের সেরা গোলরক্ষক দেবজিৎ মজুমদার তখন ১৪বছর, খেলার দৌড় স্থানীয় মাঠ। কিংশুক দেবনাথ সবে পা রেখেছেন কলকাতা ময়দানে।
আর প্রীতম কোটাল ? তখন ১০ বছরের শিশু। ফুটবলের সঙ্গে পরিচয় হচ্ছে সবে সবে। তাই জাতীয় লিগ জয়ের উৎসব এখানে কেমন সে সম্পর্কে কোনও স্পষ্ট ধারনাই ছিল না আজকের আই লিগ জয়ের নায়কদের। এই ১৩ বছরে যখন ওঁরা তৈরি করছিলেন নিজেদের, সেই ১৩টা বছরে কোনও জাতীয় লিগ বা আই লিগ আসেনি কলকাতার কোনও ক্লাবে। ঠিক তার পরের বছর কলকাতাকে শেষ জাতীয় লিগ এনেদিয়েছিল ইস্টবেঙ্গল। তারপর শুধুই শূন্যতা!
অথচ এই খরার সময়ও একটুও কমাতে পারেনি বাংলার ফুটবলপ্রেমীদের উন্মাদনা। শেষের ক’বছর উৎসাহে হয়তো কিছু টান পড়েছিল। কিন্তু আবেগে ভাটার টান কখনো পড়েনি। আর তাই তো এত বছর পর ক্লাবের সাফল্যে সমর্থকরা হাজির হয়েছিলেন এয়ারপোর্টে। মুখে প্রশান্তির হাসি আর চোখ ভর্তি জল নিয়ে। শুধু সৌভিক শিলটন, প্রীতমরা কেন, যে হাজার হাজার মানুষ সেদিন ক্লাব লনে দাঁড়িয়ে আর্থিক বৈষম্য, ধর্মীয় বৈষম্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি র বৈষম্য ভুলে এক সঙ্গে গলা মেলাচ্ছিলেন “আমাদের সূর্য মেরুন’’এর তালে, তাঁদের অনেকেই তো জীবনে আগে দেখেননি দুই প্রধানের এমন সাফল্য! তবু তাঁদের কীসের আবেগ ? কোথা থেকে আসে এই আবে ? বিশ্বফুটবলে ১৫০ এর পিছনে থাকা একটা দেশের দু’টো ক্লাবকে ঘিরে এই উন্মাদনা কী করে সম্ভব ? কে সেদিন সঙ্ঘবদ্ধ করে ওঁদের এয়ারপোর্টে আনতে পাঠালো দলকে ? কোন অমোঘ শক্তি সাজিয়ে দিল সব পরিকল্পনা ? কোনও উত্তর নেই এর। ব্যাখ্যাও নেই। এই আবেগ যেন বিশ্বের অষ্টম আশ্চর্য! যা অনন্তঃ অবিনশ্বর।