স্বরূপ গোস্বামী
কোনও কোনও জয় আসলে পরাজয়ের বার্তা বয়ে আনে। সিঙ্গুর মামলায় সুপ্রিম কোর্টের রায় দেখার পর সেটাই মনে হচ্ছে।
মমতা ব্যানার্জি চেয়েছিলেন, সিঙ্গুরের জমি কৃষকদের ফেরত দেওয়া হোক। শাসনক্ষমতায় এসে প্রথম ক্যাবিনেটেই তিনি এমন একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। বিধানসভায় এই নিয়ে নতুন আইনও এনেছিলেন। তাঁর খুশি হওয়ারই কথা। তাঁর রাজনৈতিক জয়ের কথাই ফলাও করে প্রচার হচ্ছে।
আপাত দৃষ্টিতে দেখতে গেলে, এটা অবশ্যই মমতা ব্যানার্জির বড় জয়। অতি উৎসাহীরা এই আন্দোলনকে সিলেবাসে আনার প্রস্তাবও দিচ্ছেন। ধরেই নেওয়া যায়, এটা সিলেবাসে ঢুকবে। ছাত্র-ছাত্রীরা সিঙ্গুরে নেত্রীর লড়াইয়ের গৌরবকাহিনী পড়বে।
কিন্তু এতে আখেরে কতখানি লাভ হল ? সিঙ্গুরে মমতা হয়ত জিতলেন, কিন্তু বাংলা হারল। শিল্পের ক্ষেত্রে এই রায় রাজ্যকে কতখানি অন্ধকারে ঠেলে দিল, অনেকেই হয়ত বুঝে উঠতে পারছেন না। জমি নেওয়ার পদ্ধতিতে হয়ত ভুল ছিল। কোথাও তাড়াহুড়ো ছিল। হয়ত আরও অনেকের সঙ্গে কথা বলতে পারলে ভাল হত। পদ্ধতিগত ত্রুটিকে মেনে নিয়েও বলতে হবে, সদিচ্ছায় কোনও ঘাটতি ছিল না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যও চেয়েছিলেন শিল্পের মানচিত্রে রাজ্যকে আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে। টাটা এলে তার পিছু পিছু আরও অনেক কোম্পানি এই বাংলায় শিল্প করতে আসবে, এটা ভেবেই হয়ত একটু বেশি তাড়াহুড়ো হয়ে গিয়েছে।
কিন্তু টাটাকে তাড়ানো-টা কি ঠিক ছিল? গত পাঁচ বছরে কোনও বড় মাপের শিল্পই এই রাজ্যে আসেনি। ২০১১ তেও ঢাক পিটিয়ে বলা হয়েছে, প্রচুর নাকি বিনিয়োগ আসছে। ২০১৬ তেও সেই কুমীর ছানাই দেখানো হচ্ছে। কোথায় বিরাট মাপের লগ্নি, কোথাও কর্মসংস্থান, তার কোনও স্পষ্ট উত্তর নেই।
জমি আর তোলাবাজি দুটো বড় সমস্যা। এই দুই চরম সত্যিকে যদি অস্বীকার করা হয়, তাহলে বুঝতে হবে, বাস্তবের সঙ্গে তাঁর কোনও সম্পর্ক নেই। অথবা, সত্যি কথা বলতেও তাঁরা ভয় পান। এই দুটো সমস্যা দিন দিন বাড়ছে। শিল্প করতে গেলে কী কী ঝামেলার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়, শিল্পপতিরা হাড়েহাড়ে বোঝেন। তাই শিল্প সম্মেলনে তাঁরা ভাল ভাল কথা বলবেন। সরকার যা শুনতে চায়, সেই কথাই বলবেন। মিডিয়ার সামনে বলবেন, ‘দারুণ উন্নয়ন হচ্ছে’। কিন্তু কাজের কাজ, অর্থাৎ বিনিয়োগ করার সময় গুটিয়ে যাবেন।
সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ে সরকার যতই উল্লসিত হোক, এই রায় ভবিষ্যতের অশনি সংকেত। জমি ফেরতের দাবিতে যাঁর নাম ইতিহাসে উঠতে চলেছে, তাঁর পক্ষে আগামীদিনে জমি অধিগ্রহণ করা রীতিমতো কঠিন হবে। শিল্পপতিদের পক্ষেও ছোট ছোট জমির মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে বোঝানো সম্ভব নয়। গজিয়ে উঠবে ফড়েবাজি বা দালালচক্র। তারাই অনেক কিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন। যাঁরা জমি দিতে চাইবেন না, তাঁদের পেছনে সুপারি কিলার লাগালেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। যেভাবে একের পর এক পঞ্চায়েত বা পুরসভা দখল হচ্ছে, সেভাবেই জমি দখল হবে না তো ?
সিঙ্গুর আন্দোলনের কথা সিলেবাসে ঢোকানোর আগে আরও ভাল করে ভাবুন। এই অতি উৎসাহ ব্যুমেরাং হয়ে যাবে না তো ?