সজল মিত্র
গত দুদিন টিভিতে নানা আলোচনা শুনি। কাগজে অনেক কিছু পড়ছি। মনে হচ্ছে, যত রিগিং আর ছাপ্পা বোধ হয় সল্টলেক-রাজারহাটেই হয়েছে। শিলিগুড়ি নিয়ে খুব একটা উচ্চ বাচ্য দেখছি না। অনেকের ধারণা, শিলিগুড়ির ভোট বোধ হয় খুব শান্তিপূর্ণ হয়েছে। এমনকি শিলিগুড়ির বাম নেতারাও ভাবছেন, সন্ত্রাস রুখে দেওয়া গেছে। জয় নিশ্চিত।
কিন্তু এই আত্মতুষ্টি বিপদ ডেকে আনতেও পারে। সঠিক কী হয়েছিল, তাঁদের কাছেও বোধ হয় খবর নেই। ফাসিদেওয়া, খড়িবাড়ি, নকশালবাড়ি, মাটিগাড়া- এই চারটি ব্লকে ছিল নির্বাচন। ফাঁসিদেওয়ার বেশ কিছু বুথে মারাত্মক সন্ত্রাস ও ছাপ্পা চলেছে। খড়িবাড়ি ও নকশালবাড়িতে বামেদের প্রতিরোধ ছিল। তাই তেমন কিছু করা যায়নি। সবথেকে বেশি ছাপ্পা চলেছে মাটিগাড়ায়।
শিলিগুড়ি শেষ আর মাটিগাড়া শুরু। একেবারেই শহরের লাগোয়া। সেখানকারই একটি বুথে ভোটের ডিউটি করেছি। ইচ্ছে করেই নামটা নির্দিষ্ট করে লিখছি না। কারণ, নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রশাসনের উপর এতটুকুও আস্থা নেই। বিশেষ করে এই ভোটে প্রশাসনকে যে নগ্ন চেহারায় দেখলাম, তাতে ভরসা আরও উঠে গেছে।

না, আমার বুথে বিরাট পরিমাণে ছাপ্পা হয়নি। তবে আমাদের সেক্টরে ছিল ১৪ টি বুথ। তার মধ্যে ৬ টি পুরোপুরি দখল হয়ে যায়। ফাসিদেওয়ায় অন্তত দশটি বুথ পুরোপুরি দখল হয়ে যায়। আমার বুথের অভিজ্ঞতা একটু তুলে ধরা যাক। বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত ভোট। ভোট চলাকালীন তেমন ছাপ্পা হয়নি। একেবারে শেষবেলায় এসে যা হল্, সেটা এখনও ভুলতে পারছি না। নিয়ম হল, পাঁচটার সময় যাঁরা লাইনে থাকবেন, তাঁদের টোকেন দিতে হয়। সেই টোকেন নিয়ে তাঁরা ভোট দিতে পারবেন। বাইরে গিয়ে দেখলাম, কেউ নেই। অর্থাৎ, কাউকে টোকেন দিতে হবে না। হঠাৎ একজন বলল, বাইরে অনেকে আছে। শুনলাম, ৩৭ জন। তাদের হাতে টোকেন দেওয়া হল। একে একে সবাই ভোট দেবে। হঠাৎ একজন ভোটার কার্ড বের করল। এক ভোট কর্মী বললেন, এটা তো মেয়েদের কার্ড। আপনি তো ছেলে।
ব্যাস, এবার স্বমূর্তি ধারণ করল। আমাদের সবার ঠিকুজি-কুষ্ঠি আগে থেকেই জেনে নিয়েছিল। শাসানো হল। আমাকে নিয়ে যাওয়া হল বাথরুমে। বলা হল, বাইরে সিগারেট খেয়ে আসুন। বুঝলাম, কী হতে চলেছে। একা এদের সঙ্গে পেরে উঠব না। বাথরুমে গিয়ে কন্ট্ট্রোলে এস এম এস পাঠালাম এল ডব্লু। অর্থা! ল অ্যান্ড অর্ডার। সেক্টরে এই রকম বার্তা পাঠালে সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ আসার কথা। বুঝলাম, বিপদ হতে পারে। হোয়াটস আপে বন্ধুদের গ্রুপে মেসেজ পাঠালাম। আই অ্যাম ইন ট্রাবল। যোগাযোগ করলাম বিডিও-র সঙ্গে। বুঝিয়ে দেওয়া হল, যা চলছে, তাই যেন চলতে দেওয়া হয়। আবার বুথে ফিরে এলাম। ঢুকেছিল ৩৭ জন। ছাপ্পা মারা হয়েছে সত্তরটা। ওরা বলল, এবার সিল করে দিন। সেখান থেকেই সেক্টরে জানালাম। সেখান থেকে জানানো হল, কিছু করার নেই। আরও ছটা বুথে নাকি এর থেকেও খারাপ অবস্থা হয়েছে।
আমি যেন রিপোর্টে বুথ দখলের কথা না লিখি, বারবার সেটাই সমঝে দেওয়া হল। কিন্তু এত বেশি ভোট যে পড়ে গেল? বলা হল, যারা আসেনি, তাদের নামে বসিয়ে দিতে। আবার যোগাযোগের চেষ্টা করলাম থানা ও ব্লক অফিসের সঙ্গে। বুঝলাম, এরা কেউ আমার সাহায্যে এগিয়ে আসবে না।
আমার আরেক বন্ধুর অভিজ্ঞতা সাঙ্ঘাতিক। সেখানে সকাল থেকেই দখল। বিরোধী এজেন্টদের মেরে আগেই এলাকাছাড়া করা হয়েছিল। সে যখন ভোট শুরুর আগে সব দলের এজেন্টদের দেখতে চাইল, তখন তাকে বলা হল, স্যার এখানে আর কেউ নেই। আমরা একাই। একেবারে ওপেন ভোট হবে। সেটা কী রকম? একেক জন আসছে, হাতি কালি লাগানো হচ্ছে। অন্য দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। কষ্ট করে আর ভোট দিতে হচ্ছে না। সেখানে এক মূর্তিমান দাঁড়িয়ে আছে। সে পরম আনন্দে সমাজসেবা করে যাচ্ছে। দুপুর দুটোর মধ্যেই নব্বই শতাংশ ভোট পড়ে গেল। সবই কি শাসক দলে ? নাকি নিজেরাই দু একটা উল্টো দিকে দিয়ে রেখেছে, তা অবশ্য সে জিজ্ঞেস করেনি। তাকেও কাগজে কলমে রিপোর্ট দিতে হল, শান্তিপূর্ণ ভোট। সত্যিই, এর থেকে শান্তিপূর্ণ ভোট আর কী হতে পারে ?
নির্বাচন কমিশনের খাতায় এই ভোট শান্তিপূর্ণই থেকে যাবে। এমনকি অশোক ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকাররাও ভাবছেন, ভোট শান্তিপূর্ণ। এইসব বুথে তাঁদের যে এজেন্টটুকুও ছিল না, এই খবরটা তাঁদের কাছে আছে তো ?
অশোকবাবুরা ভাবছেন, বিরাট ব্যবধানে জিতবেন। হয়ত লাল আবির কিনে রেখেছেন। সবমিলিয়ে হয়ত জিতেও যাবেন। কিন্তু মাটিগাড়া ও ফাঁসিদেওয়ায় যে ছবি দেখলাম, অশোকবাবুদের হতাশ হতে হবে। অন্তত এই বুথগুলোতে অস্বাভাবিক ফলের জন্য তাঁরা এখন থেকেই তৈরি থাকুন।
(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন। লেখকের নাম গোপন রাখা হল। কিন্তু কোনও কাল্পনিক ঘটনা নয়। শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদে এটাই ছিল ভোটের চিত্র।)