বাবা প্রাণ দিয়েছেন কার্গিলের যুদ্ধক্ষেত্রে। মেয়ে গুরমেহেরও লড়ে যাচ্ছে নিজের ময়দানে। লড়াকু সেই মেয়েটির পাশে না দাঁড়িয়ে উল্টে তাঁকে কটাক্ষ করলেন বীরেন্দ্র শেহবাগ! তাঁকে খোলা চিঠি। লিখলেন শতরূপ ঘোষ।।
আমাদের বেড়ে ওঠার দিনগুলো আর আপনার ঝোড়ো ইনিংসগুলো যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত। আমরা ব্র্যাডম্যান দেখিনি। সোবার্স দেখিনি। তিরাশির বিশ্বজয়ও দেখিনি। কপিল দেব যখন বিদায় নিলেন, তখন নেহাতই ছোট। হ্যাঁ, পেয়েছিলাম শচীন তেন্ডুলকারকে। পেয়েছিলাম আমাদের বাংলার মহারাজকে। আর দেখেছি আপনাকে। শচীন যখন একটু একটু করে নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন, তখনই আপনি যেন নিজেকে দারুণভাবে মেলে ধরছেন। বিশ্বের তাবড় তাবড় বোলাররাও বুঝে উঠতে পারতেন না পরের বলটা কোথায় ফেলবেন। দারুণ একটা বলকেও কী অবলীলায় আপনি পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্যালারিতে। এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই বিকশিত হয়েছে আমাদের তারুণ্য।
কেউ কেউ বলত, বীরেন্দ্র শেহবাগ মানেই বেপরোয়া। কিন্তু টেস্টে ভারতের হয়ে প্রথম ট্রিপল সেঞ্চুরি করলো কে? গাভাসকার বা শচীন নয়, মিস্টার ডিপেন্ডেবল রাহুল দ্রাবিড়েরও নয়। আপনি। তাও আবার একটা নয়, দু–দুটো। আরও একটা হতেই পারত, সেবার মাত্র সাত রানের জন্য হয়নি। সেই আপনাকে একটা পোস্টার হাতে একটা ছবিতে দেখলাম। লিখেছেন I didn’t score two triple centuries, my bat did. আপনার চিরকালের ভক্ত হয়েও, কেন জানি না, আপনার এই শটটা একেবারেই মেনে নিতে পারছি না।
যাঁরা একটু আধটু চারপাশের খবর রাখেন, তাঁরা বুঝতে পারবেন হঠাৎ কেন এরকম একটা টুইট আপনাকে বাজারে ছাড়তে হল। তার আগে দিল্লি ইউনিভার্সিটির এক তরুণী ছাত্রী একইভাবে টুইট করেছিল— “PAKISTAN did not kill my dad. WAR killed him.” অর্থাৎ, পাকিস্তান আমার বাবাকে খুন করেনি, যুদ্ধ তাঁকে খুন করেছে। এই কথাটা সবার হয়ত ভাল লাগবে না। বিশেষ করে যুদ্ধে প্রাণ হারানো জওয়ানদের কফিন বেচে কাট-মানি খাওয়া বি.জে.পি. আর তাদের বন্ধু-বান্ধবদের তো ভালো লাগার কথাই নয়। স্বভাবতই তারা যা করার, তাই করছে। বীরুভাই, আপনি কি জানেন, এই মন্তব্যের পর সেই ছাত্রীকে ধর্ষণের হুমকি পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে? এই ছাত্রী হল গুরমেহের কাউর, যার বাবা কার্গিল যুদ্ধে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। আমরা যখন বিজয়উল্লাসে মগ্ন ছিলাম, এই মেয়েটি দেখেছে, তার বাবার কফিনবন্দী দেহ। আপনার ট্রিপল সেঞ্চুরি যেমন দেশকে গর্বিত করেছে, তেমনি এই মেয়েটির বাবার আত্মত্যাগের বিনিময়ে কার্গিলের জয়ও আমাদের মাথা উঁচু করেছে। কিন্তু মেয়েটি নিজের জীবন দিয়ে বুঝেছে যুদ্ধ কতখানি ভয়াবহ হতে পারে। তাই আমরা কেউ কেউ যখন ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে প্রাইম টাইম নিউসে যুদ্ধোন্মাদনা দেখতে দেখতে দেশপ্রেমের অস্ত্রে শান দিই, গুরমিতের হয়ত ওর বাবার মৃতদেহটা মনে পড়ে যায়।
আপনি হয়তো জানবেন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে ব্রিটেনে চালু হয়েছিল Conscription – বাধ্যতামূলক যুদ্ধে অংশগ্রহণ। কলেজ -বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া হাজার হাজার তরুণকে তাদের বই-খাতা তুলে রেখে প্রিয়জনদের বিদায় জানিয়ে রওনা হতে হতো যুদ্ধে। হয়ত আর কোনদিন না ফিরে আসার জন্য। সেদিন ট্রেঞ্চ-এ বসে, ট্রিগার এ আঙ্গুল রেখে জন্মে নিয়েছিল Wilfred Owen, Siegfried Sassoon দের মতো কবিরা, যারা যুদ্ধের নিস্ফলতা, মানবসম্পদের অপচয়, জীবনের ক্ষয় নিয়ে একের পর এক কবিতা লিখে গেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে। যুদ্ধ করতে করতে। সাহিত্যের ইতিহাস এদের মনে রেখেছে ‘War Poets’ বলে। অথচ এমন একটা সময়ে ইংলিশ মহাকবি টি.এস. এলিয়টের কলম থমকে দাঁড়িয়েছিল কারণ তিনি যুদ্ধ সম্পর্কে অবস্থান নিতে গিয়ে দিশা হারিয়েছিলেন। আর এদিকে সত্যিকারের যুদ্ধে লড়তে লড়তে এই তরুণরা সেদিন বুঝেছিল, বন্দুকের নিশানা যেদিকেই থাকুক না কেন, সেও এক রক্ত-মাংসের মানুষ যে জীবনের সমস্ত পূর্ণতা নিয়েই বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। ঠিক যেমন মুলতানের পিচে দাঁড়ানো আপনি জানতেন শোয়েব আখতার, সাকলিন মুস্তাকরা আপনার শত্রু নয়, প্রতিপক্ষ।
বীরু, আপনিও সৈনিক। আপনিও দেশের হয়ে যুদ্ধ করেছেন। তবে সেই যুদ্ধ ব্যাট–বলের যুদ্ধ। আপনার যুদ্ধ, আর গুরমেহের যে যুদ্ধে তার বাবাকে হারিয়েছে, সে দুটো আলাদা। আপনি যেদিন ক্রিকেটের ময়দানে দেশের হয়ে লড়াই করার ডাক পেয়েছিলেন, আপনার পরিবার ভেসে গেছিল উৎসবের বন্যায়। হয়তো আপনার মা আনন্দে সারারাত চোখের পাতা এক করতে পারেননি। কিন্তু আপনি কি বোঝেনা না, গুরমিতের বাবারা যখন যুদ্ধে ডাক পান, তখন তাঁদের আপনজনেরাও রাত জাগেন। দুশ্চিন্তায়। আপনার ব্যাটের জোরে দেশ জিতলে আপনি ম্যান-অফ-দা-ম্যাচ হতেন। কিন্তু হারলে? সত্যি করে বলুন তো, আপনার খুব কি অসুবিধা হতো? হারলেও ম্যাচ ফি বাবদ লক্ষ লক্ষ টাকা আপনার অ্যাকাউন্টে ঢুকে যেত। সেঞ্চুরি করলে দেশে নায়কের মর্যাদা পেয়ে এসেছেন। হারলেও হাজার হাজার অটোগ্রাফের খাতা এগিয়ে এসেছে আপনার দিকে। কত কিশোরের দেওয়ালে টাঙানো থেকেছে আপনার ছবি। জিত আর হারের মধ্যে কতটুকুই বা তফাৎ ছিল আপনার যুদ্ধে? অবশ্য এই একটা জায়গায় গুরমিতের বাবার সঙ্গে আপনার লড়াইয়ের খুব মিল। ওনার পাওনাও কি হার-জিত নির্বিশেষে এক নয়? যুদ্ধে ওনার টিম, আমাদের টিম তো জিতেছিল। তবুও ওনাকে ফিরতে হয়েছিল কফিন বন্দী হয়ে। সীমান্তের এই যুদ্ধে জিত আসুক বা হার, মা হারাবেন সন্তানকে, স্ত্রী হারাবেন স্বামীকে, আর গুরমেহেরের মতো ছোট্ট মেয়েরা হারাবে তাদের বাবাকে।
কিন্তু এই সৈনিকদের কজনের নাম আমরা জানি? যাঁরা সিয়াচেন সীমান্তে ওই বরফের মাঝে শীতের রাতে দাঁড়িয়ে দেশকে রক্ষা করছেন, তাঁদের কজনকে আমরা চিনি? বীরু, আমরা ক্রিকেট ভালোবাসি। আপনার দুটো ট্রিপল সেঞ্চুরির কথা আমরা মনে রেখেছি। যতদিন ক্রিকেট খেলা বেঁচে থাকবে, ততদিন মনে রাখব। কিন্তু আপনার ফ্যান হয়ে জানতে চাইছি, আপনি তো দেখছি যুদ্ধ ভালোবাসেন। তা গুরমিত কাউর এ.বি.ভি.পি.-র বিরুদ্ধে ওই ছবিটা টুইট করার আগের মুহূর্ত পর্যন্ত আপনি নিজেও কি জানতেন কার্গিল যুদ্ধের শহীদ, ক্যাপ্টেন মনদীপ সিং- এর নাম? একা আপনাকেই বা দোষ দিই কেন? আমরা কেউ কি ওনাকে মনে রেখেছিলাম? রাখিনি। রাখিনা। খালি গুরমেহেররা ভুলতে পারে না তাদের বাবাকে।
বীরু, এই মেয়েটির যন্ত্রণা আপনাকে একটুও স্পর্শ করল না? কেন সে যুদ্ধ চায় না, আপনি বুঝতে চাইলেন না? আপনাকে নেমে পড়তে হল পাল্টা কটাক্ষের খেলায়? যেটা এবিভিপি–কে মানায়, সেটা কি আপনাকে মানায়? মেলবোর্নে ১৯৫ রানের মাথায় আপনি ছয় মারতে গিয়েছিলেন। ক্যাচ উঠে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, রেকর্ড নয়, ডাবল সেঞ্চুরি নয়, মেজাজটাই তো আসল রাজা। কিন্তু জীবনটা যে অন্যরকম। এখানে সব বলে ছয় মারতে নেই। আপনার অনেক টুইট বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। মনে হয়, খেলা ছাড়ার পরেও টুইটে আপনি দিব্যি ছক্কা মারছেন। কিন্তু এই শটটা হয়ে গেল মেলবোর্নের সেই শটটার মতো। এক শহীদের কন্যা, বাবার মতোই যে নিজের ময়দানে বুক চিতিয়ে লড়াই করছে, তার পাশে দাঁড়াতে না পারুন, তাই বলে তাকে এইভাবে কটাক্ষ করতে হবে? মুলতানের সুলতান, এই সস্তা খেলা আপনাকে মানায় না।
প্লিজ, ওই টুইট ফিরিয়ে নিন। এই পৃথিবীর বুকে সব যুদ্ধ শেষ করার এই যুদ্ধটায় আপনি গুরমেহেরদের পাশে দাঁড়ান। আপনাকে ক্রিজে নামতে দেখলে চিরকাল ভরসা পেয়ে এসেছি। এবার একবার ক্রিজে নাবুন, মানবতার হয়ে। আপনার ব্যাট থেকে আবার একটা ট্রিপল সেঞ্চুরি আসুক।