শুধুই সমাজসংস্কারক ? গদ্যের নব রূপকার নন ?

নতুন বংলা গদ্যের সন্ধান কি আজও পেয়েছি? বিদ্যাসাগরের মৃত্যুদিনে  সেই প্রশ্নই তুললেন  অন্তরা চৌধুরী।।

জীবনের শুরুতে যাঁর হাত ধরে আমরা পড়াশোনার জগতে প্রবেশ করেছিলাম, সেই বর্ণপরিচয়ের স্থান আজ রাস্তার ফুটপাতে। শুনেছিলাম মানুষ চলে যায়, কিন্তু তাঁর কীর্তি নাকি থেকে যায়! তাঁর কীর্তি থেকে গেছে পথের বিজন প্রান্তে। অনেক উচ্চবর্ণের ইংলিশ মিডিয়ামে পড়া ছেলে-মেয়েরা হয়ত বিদ্যাসাগরের নামই শোনেনি। বাংলা পড়তে বললেই নাকি তাদের ভয় লাগে। এটাও আবার তাদের বাবা-মায়ের কাছে ভীষণ গর্বের বিষয়। যাঁর মহৎ সৃষ্টিকে আমরা অবহেলার সঙ্গে গ্রহণ করেছি, যাঁর কাছ থেকে নানাভাবে উপকৃত হয়ে তাঁকে কৃতঘ্নতা উপহার দিয়েছি; বাংলা গদ্যে সেই মহাপুরুষের অবদান আরেকবার নতুন করে মূল্যায়নের অপেক্ষা রাখে বৈকি।

রামমোহন বাঙালির মননকে গভীরভাবে নাড়া দিয়ে মূঢ়তার চাটকা ভেঙে ফেলতে চেয়েছিলেন। আর বিদ্যাসাগর সেই হতভাগ্য জাতির চরিত্রে প্রেম ও পৌরুষ জাগাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু পেরেছিলেন কি? সেটা আজ তর্কের বিষয়। বাংলা গদ্যের জনক কে ? এই শিরোপা কার প্রাপ্য সেটা আজ নিতান্তই হাস্যকর। প্রাক-বিদ্যাসাগরীয় ভাষা ছিল ‘প্রয়োজনের ভাষা’। কিন্তু শিল্পসম্মত এবং মননশীল রচনার সূত্রপাত করে, বিদ্যাসাগর বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপিত করার যোগ্য করে তুলেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ স্বীকার করেছেন-“বঙ্গসাহিত্যে আমার কৃতিত্ব দেশের লোক যদি স্বীকার করে থাকেন তবে আমি যেন স্বীকার করি, একদা তার দ্বার উদ্‌ঘাটন করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।”

vidyasagar4

বাংলা গদ্যে যতির ব্যাবহার করে, পদবন্ধে ভাগ করে এবং সুমধুর শব্দ ব্যবহার করে বিদ্যাসাগর তথ্যের ভাষাকে রসের ভাষায় পরিণত করেন। বাংলা গদ্যের মধ্যেও যে এরকম ধ্বনিঝঙ্কার ও সুরবিন্যাস সম্ভব তা তাঁর আগে প্রায় কেউই জানতেন না। তাঁর পরিকল্পিত সাধুভাষাই প্রায় দেড় শতাব্দী ধরে বাঙালির লেখনীর মুখে ভাষা জুগিয়েছে। বাংলা গদ্যে ছন্দস্পন্দ এবং ধ্বনি-তরঙ্গ বিদ্যাসাগরের এক অসাধারণ কীর্তি। বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথ এই ভাষারই সার্থক অনুসারী। এই গদ্যে ছিল লাবণ্য এবং নমনীয়তা। নিয়মিত যতি স্থাপন দ্বারা তিনি বাংলা গদ্যের যে গঠন রীতি তৈরি করে দেন, পরবর্তী বাংলা সাহিত্যে এটাই আদর্শ রূপে গৃহীত হয়। প্রথম সৃষ্টির মধ্যেও তার পরিচয় সুস্পষ্টঃ ‘রে দুষ্ট, তুই মাটি খাইয়াছিস!” কৃষ্ণের প্রতি যশোদার এই উক্তিতে ‘জিজ্ঞাসা’ বড় নয়-বড় পুত্রবৎসলা মাতার “বিপন্ন বিষ্ময়”। তাই প্রশ্নচিহ্নের (?) বদলে আশ্চর্য চিহ্নের(!) ব্যবহার এখানে লক্ষ করা যায়। শুধু যতিস্থাপন নয়, প্রত্যয় বিভক্তি নিয়োজিত সংশ্লিষ্ঠ(Synthetic) সংস্কৃত ভাষার উত্তরসূরি হলেও বাংলা ভাষা যে কালধর্মে অবস্থানিক(Positional)এবং বিশ্লিষ্ট (Analytical) রূপে বিবর্তিত হয়েছে, বিদ্যাসাগরই সর্বপ্রথম বাংলা ভাষার এই রূপতাত্ত্বিক পরিবর্তনটি আবিষ্কার করেন। তখন থেকেই বাংলা ভাষার বাক্যে গঠন এই রীতিরই অনুসরণ করে চলেছে। পরবর্তীকালে বাংলা গদ্যের যে রীতিকে সাহিত্যিকরা শিরোধার্য করেছেন, সেই লাবণ্যমণ্ডিত বাংলা গদ্যের প্রবর্তক ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।

তাঁর অনুবাদ গ্রন্থের তালিকা বেশ বড় হলেও মৌলিক রচনার সংখ্যাটাও নেহাত কম নয়। বিধবা-বিবাহ আন্দোলনের বিরুদ্ধে যাঁরা প্রতিপক্ষ ছিলেন, যাঁদের একমাত্র কাজ ছিল বিদ্যাসাগরের নামে অলীক কুৎসা প্রচার করা, তাঁদের জন্য বিদ্যাসাগর ছদ্মনামে খানকয়েক পুস্তিকা লিখেছিলেন। সরস ও ব্যাঙ্গের ভাষায় সেই সমস্ত প্রতিবাদীর হাস্যকর অভিমত ছিন্ন করে বিতর্কমূলক রচনায় লঘু রসের পরিচয় দিয়েছিলেন তিনি। ‘অতি অল্প হইল’, ‘আবার অতি অল্প হইল’, এবং ‘ব্রজবিলাস’ এই তিনখানি বই ‘কস্যচিৎ উপযুক্ত ভাইপোস্য’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়। ‘রত্নপরীক্ষা’ ‘কস্যচিত উপযুক্ত ভাইপো সহচরস্য’ ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছিল। প্রতিপক্ষকে হাস্যকর রঙ্গব্যাঙ্গের তির্যক আক্রমনে একেবারে ধরাশায়ী করে দেওয়ার বিচিত্র বিতর্কধারা সৃষ্টি তাঁর অবদান। এতে রঙ্গব্যঙ্গ থাকলেও স্থূলতা নেই। সহজ হাস্যপরিহাস থাকলেও গভীর ও যুক্তিপূর্ণ আলোচনার অভাব নেই। এরকম উচ্চ অঙ্গের রসিকতা বাংলা ভাষায় অতি অল্পই আছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে যথার্থই বলেছিলেন-‘বিদ্যাসাগর বাংলা গদ্য ভাষার উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে সুবিভক্ত, সুবিন্যস্ত, সুপরিচ্ছন্ন এবং সুসংযত করিয়া তাহাকে সহজ গতি এবং কার্যকুশলতা দান করিয়াছেন।এখন তাহার দ্বারা অনেক সেনাপতি ভাবপ্রকাশের কঠিন বাধা সকল পরাহত করিয়া সাহিত্যের নব নব ক্ষেত্র আবিষ্কার ও অধিকার করিয়া লইতে পারেন-কিন্তু যিনি এই সেনানীর রচনাকর্তা, যুদ্ধজয়ের যশোভাগ সর্বপ্রথম তাঁহাকে দিতে হয়।’

 

‘শকুন্তলা’, ‘সীতার বনবাস’ এক অসাধারণ অনুবাদ। সেই দুঃখিনী রাণীর কাহিনি পড়তে পড়তে পৌরাণিক পরিবেশে চলে যায় পাঠকমন। ‘সীতার বনবাসে’ সেই নিসর্গের বর্ণনা অপূর্বঃ

“আর্য! এই সেই জনস্থানমধ্যবর্তী প্রস্রবণগিরি। এই গিরির শিখরদেশে আকাশপথে সততসঞ্চরমান জলধরমণ্ডলীর যোগে নিরন্তর নিবিড় নীলিমায় অলঙ্কৃত।” ভাষার এমন সাবলীল গতি, শব্দ ধ্বনির ব্যবহার প্রশংসনীয়।

vidyasagar3

‘ভ্রান্তিবিলাসের’ গদ্যে শুনি বঙ্কিমের দূরাগত পদধ্বনি। কোন কোন জায়গায় ভাষা আশ্চর্য নিরাভরণ-

“বলি, টাকা কোথায়? সে বলিল, আর টাকা কোথায় পাইব? আমার নিকটে যাহা ছিল তাহা দিয়া এই দড়ি কিনিয়া আনিয়াছি।”

vidyasagar2

উপরোক্ত আলোচনা থেকে সহজেই বোঝা যায় যে, বাংলা গদ্যের কায়া নির্মাণে যাঁরাই দায়ী থাকুননা কেন, এর শ্রী ও হ্রী –বিদ্যাসাগরের দান। আধুনিককালের গদ্যে অনেক বৈচিত্র দেখা গেলেও পদান্তর ও যতিবন্ধনে এখনও আমরা বিদ্যাসাগরকে ছাড়িয়ে নতুন কোনও পথ আবিষ্কার করতে পারিনি।

‘বর্ণপরিচয়’ এর সেই গোপালকে মনে আছে? যার কথা পড়তে পড়তে সেই ছোট্ট বয়সে নিজের অজান্তেই চরিত্র গঠন হয়ে যেত। নীতিশিক্ষা নিঃশব্দভাবে রক্তে মিশে যেত। শিশুমনে সেই কুজ্ঝ্বটিকার রহস্য ভেদ কি আজও হয়েছে? সেই বরণীয় এবং চিরস্মরণীয় মহাপুরুষের অবদান উপলব্ধি করার মহত্ত্ব আমাদের নেই। সোনার তরীর মাঝি এসে নিয়ে গেছেন তাঁকে। আর আমাদের দিয়ে গেছেন তাঁর সৃষ্টি। আজ থেকে বহুযুগ পরেও তিনি থেকে যাবেন ‘হৃদা মণীষা মনসার’ উপলব্ধির যাথার্থ্যে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.