শতবর্ষে পুজোও পেলেন না, জাস্টিসও পেলেন না

স্বরূপ গোস্বামী

আমার দেখা প্রথম ছবি কী?‌ নামটা ভুলে যাওয়ার কথা নয়। কাবুলিওয়ালা। না, হলে গিয়ে নয়। ছবিটা দেখেছিলাম টিভিতে। আরও একটা কথা অকপটে স্বীকার করা দরকার। তখনও আমাদের বাড়িতে টিভি আসেনি। এমনকী আমাদের সেই মফস্বলি এলাকার সব পাড়াতেও আসেনি। যতদূর মনে পড়ে, গোটা এলাকার দুটো বা তিনটে বাড়িতে টিভি ছিল। আমার বয়স তখন কত?‌ বড়জোর পাঁচ বা ছয় হবে। সিনেমা কী জিনিস, সেটাও জানি না। আর টিভি বস্তুটি ঠিক কী, সেটাও জানি না। আমাকে নিয়ে গিয়েছিল পাড়ারই এক দিদি। যেতে যেতে সেই দিদি বলেছিল, জানিস তো, এটা রবীন্দ্রনাথের লেখা।

আমার সাদা মনে তখন সত্যিই কোনও কাদা ছিল না। আমি জানতাম, রবীন্দ্রনাথের দাড়ি আছে। তাই রহমত রূপী ছবি বিশ্বাসকেই রবীন্দ্রনাথ ভেবে নিয়েছিলাম। মিনি আর রহমতের সেই কাহিনী সেই বয়সে যেটুকু বোঝার, সেটুকুই বুঝেছিলাম। ফিরে এসে পাড়ায় বন্ধুদের কাছে বেশ কয়েকদিন ধরে সেই গল্প বলেছিলাম। প্রায়ই বলতাম, আমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দেখেছি।

শিশু মনে সেই প্রথম দাগ কাটা। তখন অভিনেতাদেরই চিনতাম না, পরিচালক তো বহু দূরের ব্যাপার। আরও কিছুদিন পরে, সিনেমা আর্টিস্ট বলতে বুঝলাম, অমিতাভ বচ্চন আর মিঠুন চক্রবর্তীকে। যতদূর মনে পড়ে, তপন সিনহা নামটা ক্লাস এইট বা নাইনে প্রথম শুনি। টিভিতে আতঙ্ক সিনেমাটা দিয়েছিল। অনেকে বলতে শুরু করল, এটা তপন সিনহার ছবি। ততদিনে আমি সৌমিত্র চ্যাটার্জিকে চিনে গেছি। প্রসেনজিৎ, শতাব্দী রায়কেও চিনে গেছি। এই তিনজন সেই ছবিটায় ছিলেন। তাহলে তপন সিনহা কোন লোকটা?‌ এবার দেখলাম, ঝিন্দের বন্দি। যথারীতি, আমার কাছে ওটা উত্তম কুমার আর সৌমিত্র চ্যাটার্জির ছবি। এরই ফাঁকে একদিন দেখে ফেললাম সবুজ দ্বীপের রাজা। তখনও শমিত ভঞ্জকে চিনতাম না। ভিলেন বিপ্লব চ্যাটার্জিকে একটু একটু চিনতাম। তবে তার আগে লাইব্রেরির সৌজন্যে কাকাবাবুর কয়েকটা উপন্যাস পড়া। তাই আমার কাছে এই ছবিটা হয়ে রইল কাকাবাবু–‌সন্তুর ছবি। এবার দেখলাম, গল্প হলেও সত্যি। এবারও আমার কাছে এটা রবি ঘোষের ছবি।

গুরুদক্ষিণা–‌অমর সঙ্গীর আবহে বেড়ে ওঠা কিশোরের পক্ষে আলাদা করে তপন সিনহাকে চেনা মুশকিলই ছিল। তাঁর ছবি যে টিভিতে খুব বেশি দিত, এমন নয়। ফলে, তপন সিনহা নামটা কখনও কখনও শুনতাম। আবার হারিয়েও যেত। একদিকে বড় পরিচালক বলতে একসঙ্গে উচ্চারিত হত সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটকের নাম। তিনজন যেন বাংলা ছবির ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বর। অন্যদিকে, তখনকার বাজারি ছবির পরিচালক অঞ্জন চৌধুরি, স্বপন সাহাদের নামও শুনছি। অনেক পরে বুঝলাম, এই দুইয়ের মাঝামাঝি একটা রাস্তা আছে। সেই রাস্তাটা তপন সিনহা, তরুণ মজুমদারদের। যাঁদের ছবিতে বিনোদনও আছে, আবার শিল্পগুণও আছে। যেটা ঠিক আর্ট ফিল্মও নয়, আবার বাজারি ছবিও নয়।

আমার প্রিয় ছবি কোনটা?‌ বা বলা যায়, কোন ছবিটা আমি সবথেকে বেশিবার দেখেছি?‌ না, কোনও গুরুগম্ভীর ছবি নয়। যে ছবিটা সবথেকে বেশিবার দেখেছি, তা হল ‘‌গল্প হলেও সত্যি।’‌ এখনও টিভিতে যখনই হয়, থমকে যাই। আবার দেখতে ইচ্ছে করে। যে কোনও একটা সংলাপ বলুন। পরের সংলাপটা হয়তো বলে দিতে পারব। অনেক ভেবেছি, ছবিটার মধ্যে কী এমন আছে?‌ কেন বারবার চোখ আটকে যায়?‌ কেন সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিকের কোনও ছবিকে না বেছে এই ছবিটা প্রিয় ছবি হয়ে ওঠে?‌ একেক বয়সে ছবিটা একেকভাবে ধরা দিয়েছে। অনেকের কাছেই জানতে চাই, তোমার প্রিয় ছবি কী?‌ এটা সেটা ভাবতে থাকে। কিছু একটা উত্তর দেয়। কিন্তু সেই উত্তরে জোর থাকে না। একটু পরে হয়তো অন্য নাম বলে। যখন তাকে ‘‌গল্প হলেও সত্যি’‌র কথা মনে করিয়ে দিই, অমনি দেখি সে শিবির বদল করে ‘‌গল্প হলেও সত্যি’‌কেই বেছে নেয়। সেও বলে, হ্যাঁ, মনেই ছিল না। এটাই আমারও প্রিয় ছবি।

পথের পাঁচালি মুক্তি পায় ১৯৫৫ তে। মৃণাল সেনের রাতভোরও মুক্তি পায় সেই বছরেই। কিন্তু তপন সিনহার ‘‌অঙ্কুশ’‌ মুক্তি পায় ১৯৫৪ তে। অর্থাৎ, এক বছর আগে। অর্থাৎ, সেদিক থেকে দেখতে গেলে, ছবি মুক্তির নিরিখে তিনি সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনদের পূর্বসূরি। মাঝে মাঝে ভাবি, একজন মানুষের মধ্যে কত বৈচিত্র‌্য থাকে। যে মানুষটা কাবুলিওয়ালা করছেন, তিনিই আবার সাগিনা মাহাতো করছেন। যিনি ঝিন্দের বন্দী করছেন, তিনিই আবার নির্জন সৈকতে করছেন। যিনি হাঁসুলি বাঁকের উপকথা করছেন, তিনিই আবার বাঞ্ছারামের বাগানও করছেন। হিন্দির কথাই যদি ধরেন, যিনি সফেদ হাতি করেন, তিনি কীভাবে ‘‌এক ডক্টর কি মউত’‌ করতে পারেন!‌

একটা মজার কথা না বললেই নয়। অনেকে হয়তো জানেন। তবু যাঁরা জানেন না, ধরে নিন তাঁদের জন্যই। বাঞ্ছারামের বাগানে অভিনয় করার কথা ছিল উত্তম কুমারের। জমিদার ছকড়ি এবং তার ছেলে নকড়ি— দুটি ভূমিকাতেই উত্তম কুমারের করার কথা। কাগজে কলমে চুক্তিও হয়ে গেল। শীতের সময় শুটিং হওয়ার কথা। কিন্তু সেই সময় বম্বেতে উত্তম কুমারের কোনও কাজ পড়ে গেল। তিনি বললেন, মার্চ মাসের আগে সময় দেওয়া মুশকিল। উত্তম কুমার যখন বলছেন কয়েক মাস পিছিয়ে দিতে, যে কোনও পরিচালকই হাসতে হাসতে রাজি হয়ে যেতেন। কিন্তু তপন সিনহা ঠিক করে ফেললেন, কোনওভাবেই অপেক্ষা করা যাবে না। তার জন্য যদি উত্তম কুমারকে বাদ দিয়ে করতে হয়, তাই করবেন। ঠিক সেটাই করলেন। নেওয়া হল দীপঙ্কর দে–‌কে। ভেবে দেখুন, কোথায় খ্যাতির মধ্যগগনে থাকা উত্তম কুমার আর কোথায় সাতের দশকের আনকোরা দীপঙ্কর দে! ঝুঁকিটা একটু বেশিই নিয়ে ফেলেছিলেন। ‌শুটিংও হয়ে গেল। ছবিটা দারুণভাবে উতরেও গেল।

এদিকে উত্তম কুমার ব্যাপারটাকে ভালভাবে নিতে পারলেন না। চুক্তি হয়ে যাওয়ার পরেও তাঁকে বাদ দিয়ে কিনা আনকোরা নায়ককে নেওয়া হল!‌ একেবারে আদালতে মামলা ঠুকে দিলেন। অন্য কেউ হলে আদালতের বাইরে ব্যাপারটা মিটিয়ে নিতেন। অন্তত উত্তম কুমারের সঙ্গে পাঙ্গা নেওয়ার দুঃসাহস দেখাতেন না। কিন্তু তপন সিনহা কোর্টে দাঁড়িয়ে দিলেন এক মোক্ষম যুক্তি। বিচারকের সামনে সাফ জানালেন, ‘‌আমার ছবিতে মানুষের যেমন ভূমিকা আছে, প্রকৃতিরও ততটাই ভূমিকা। তিন মাস পর উত্তম কুমারকে হয়তো পেতাম। কিন্তু শীতের সর্ষেফুল কোথায় পেতাম?‌’‌ তাঁর অকাট্য যুক্তির কাছে হার মানতে হয়েছিল স্বয়ং মহানায়ককে।

একেকটি ছবির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে কত অজানা কাহিনি। আসলে, এগুলি সেভাবে সামনে আসেনি। কারণ, তিনি নিজেও বলতে চাননি। জন্ম থেকেই তিনি যেন কিছুটা আড়ালে। তাঁর জন্মদিন ২ অক্টোবর। এমন একটা দিন, সবাই জাতির জনককে নিয়েই মেতে থাকে। তাই আলাদা করে তাঁর জন্মদিনের কথা কারও আর মনে পড়ে না। ইন্টেলেকচুয়ার বাঙালি সত্যজিৎ, মৃণাল, ঋত্বিককে নিয়েই গলা ফাটায়। তিনি যেন কিছুটা ব্রাত্যই থেকে যান। তাঁর ছবিগুলো মনের মধ্যে সাজিয়ে রেখেছি। কিন্তু নেপথ্য নায়ককে সেভাবে মনে রাখিনি। বৈচিত্র‌্য যেমন আছে, তেমনই সাহসী বার্তাও তো কম নেই। ভেবে দেখুন তো, সাতের দশকে সমরেশ বসুর কাহিনি নিয়ে ‘‌আপনজন’ বানাতে গেলে কতখানি বুকের পাটা লাগে!‌ ঠিক তেমনই, বাম জমানায় ‘‌আতঙ্ক’ এর মতো ছবি করাও খুব সহজ কাজ ছিল না। প্রবাদ হয়ে যাওয়া সেই সংলাপ, ‘‌মাস্টার মশাই আপনি কিন্তু কিছু দেখেননি।’‌ এ যেন হাড় হিম হয়ে যাওয়া এক শাসানি। কিংবদন্তি চিকিৎসক সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের করুণ পরিণতি নিয়ে তৈরি ছবি ‘‌এক ডক্টর কি মউত’‌ সেও যেন শাসককে আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে দেওয়া এক ছবি।

নিঃশব্দে আরও একটা দোসরা অক্টোবর পেরিয়ে গেল। এবার ছিল শতবর্ষ। কিন্তু বাঙালির কোনও হেলদোল নেই। যথারীতি, এবারও নিঃশব্দেই পেরিয়ে গেল। কেন আমরা আত্মবিস্মৃত জাতি, আরও একবার বোঝা গেল। ছুটির দিনে আমরা দিনভর সোশ্যাল মিডিয়ায় মেতে রইলাম। কিন্তু সেই স্মার্টফোনেই তো চাইলে তাঁর একটা সিনেমা দেখা যেত। ফোনে ঘাড় গুঁড়ে থাকা বাঙালিকে বিরক্ত করবেন না। ‌‌আমরা একদিকে মেতে রইলাম পুজো উদ্বোধনে, অন্যদিকে ‘‌উই ওয়ান্ট জাস্টিস’‌ এর আন্দোলনে। বেচারা তপন সিনহা। শতবর্ষে পুজোও পেলেন না, জাস্টিসও পেলেন না।
‌‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.