(মাচা মজুমদার এবং লোটা লাহিড়ী একই পাড়ায় থাকেন। মাচাবাবু সম্পর্কে লোটাবাবুর পাড়াতুতো জ্যাঠামশাই। কিন্তু দুজনে বন্ধুর
মতই মেশেন। ঝগড়া করেন আবার দুজন দুজনকে ভালও বাসেন। রবিবারের দুপুরে তাঁদের তুমুল ঝগড়া শুনে ফেললেন ময়ূখ নস্কর।)
লোটাঃ এই যে জ্যাঠামশাই, খুব তো ফটফট করতেন। এবার কী হল? কেমন মুখ পুড়ল?
মাচাঃ আরে লোটা যে? কী খবর? সেই আই-লিগের পর থেকে তোর তো দেখাই পাচ্ছিলাম না। আমি তো ভাবছিলাম মনের দুঃখে
আবার বুঝি বর্ডার টপকে…
লোটাঃ থামুন তো মশাই! এক কাসুন্দি ঘেঁটে চলেছেন। বর্ডার, বাংলাদেশ। ওই সব ছেড়ে এবার নিজেদের কেচ্ছা কি করে সামলাবেন
ভাবুন।
মাচাঃ কেন কি হয়েছে?
লোটাঃ কী আবার হবে। আপনাদের বছর বছর নুচি, বোঁদে খাওয়ার মোচ্ছবটা এবার মাটি হবে। ক্লাবের গেটের ওই মিথ্যে কথাগুলো
মুছে ফেলতে হবে।
মাচাঃ আরে কী হয়েছে সেটা বলবি তো।
লোটাঃ আমাদের ক্লাবের এক সমর্থক, তথ্যের অধিকার আইনে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিল…
মাচাঃ কি জানতে চেয়েছিল, বাংলাদেশে তোদের কটা সুপারি গাছ আছে?
লোটাঃ সত্যি ফুটানি কাটায় আপনাদের জুড়ি মেলা ভার। ঠিক যেন, বঙ্কিমচন্দ্রের লেখা পুরানো কলকাতার বাবু। বাক্যে অজেয়। শুনুন,
আমরা জানতে চেয়েছিলাম,“ভারতের জাতীয় ক্লাব কোনটি? মোহনবাগান অনেক দিন ধরে নিজেদের জাতীয় ক্লাব বলে দাবি করে
আসছে। ভারত সরকার কি কখনও এমন ঘোষণা করেছে?“ তার উত্তরে সাফ জানানো হয়েছে, “কেন্দ্রীয় যুব উন্নয়ন এবং ক্রীড়া
মন্ত্রক কোনও ক্লাবকেই জাতীয় ক্লাব বলে ঘোষণা করেনি।“ এই দেখুন আপনার জন্য একটা প্রিন্ট আউট নিয়ে এসেছি । নিজের
চোখেই দেখুন।
মাচাঃ দেখার দরকার নেই। ফেসবুকে আমি ব্যাপারটা দেখেছি। কমেন্টগুলোও পড়েছি। আমার একটাই কথা…
লোটাঃ ও আপনিও আজকাল ফেসবুক করছেন। তাহলে তো কী বলবেন জানা আছে। আপনাদের গ্রুপগুলোতে যে সব ভাটের কথা বলা
আছে সেগুলোই বলবেন। বলবেন, চিঠিটায় সরকারি সিলমোহর নেই, অশোকস্তম্ভ নেই। দেখুন, আমার কুট্টিপিসির, রাঙ্গা ননদের
মেয়ের, ফুল কাকা সরকারি চাকরি করে। আমি যতদূর জানি, সরকারের তরফে কোনও বিজ্ঞাপন বা বিজ্ঞপ্তি জারি করলে তবেই
অশোকস্তম্ভ থাকে। আর সরকারি চিঠিতে সিলমোহর বাধ্যতামূলক নয়। তবে মেমো নাম্বার থাকা বাধ্যতামূলক। সেটা কিন্তু এই চিঠিতে
আছে।
মাচাঃ আমি বলতে চাইছি…
লোটাঃ হ্যাঁ তাও জানি। বলবেন, কেন্দ্রীয় যুব উন্নয়ন এবং ক্রীড়া মন্ত্রকের ওয়েবসাইটে অন্য অনেক চিঠির উল্লেখ থাকলেও এই
চিঠিটার কোনও উল্লেখ নেই। বেশ তো, কয়েকটা দিন অপেক্ষা করুন। দেখুন চিঠিটা আপলোড করে কি না। যদি না করে তখন
বলবেন চিঠিটা জাল। আচ্ছা, আপনারা চিঠিটা জাল প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন কেন বলুন তো? আপনি তো বয়স্ক মানুষ,
বুকে হাত রেখে বলুন তো, সংবিধানে কোথাও বলা আছে, মোহনবাগান জাতীয় ক্লাব?
মাচাঃ আমি তো তোকে সেই কথাই বলতে চাইছি। কিন্তু তুই এমন বাচাল। আচ্ছা, তোদের কি কাজকর্ম নেই? নাকি আমরা আই-
লিগ জেতায় তোরা সত্যিই পাগল হয়ে গেছিস?
লোটাঃ কেন কি করেছি?
মাচাঃ নতুন কিছু করিসনি। মামলা করাটা তোদের স্বভাব। কথাতেই আছে, বাঙালকে হাইকোর্ট দেখানো। আমরা জাতীয় ক্লাব কিনা
সেটা জানতে তোদের মামলা করতে হল? আমি বলছি শোন,তোদের চিঠিটা জাল হোক বা আসল হোক, চিঠির বক্তব্য সঠিক।
মোহনবাগান জাতীয় ক্লাব এমন কোনও কথা সংবিধানে নেই।
লোটাঃ ই-য়া-হু!!!! জেঠু আমি এক্ষুনি ফেসবুকে সবাইকে কথাটা জানিয়ে দিচ্ছি।
মাচাঃ দাঁড়া। আগে পুরো কথাটা শোন। আচ্ছা, তোদের ওই চিঠিতে কি জানতে চাওয়া হয়েছিল?
লোটাঃ দুটো প্রশ্নের উত্তর জানতে চাওয়া হয়েছিল। ভারতের জাতীয় ক্লাব কোনটি? এবং মোহনবাগান যে নিজেদের জাতীয় ক্লাব বলে
দাবি করে, এমন কোনও ঘোষণা কি কেন্দ্রীয় সরকার করেছে? এর উত্তরে বলা হয়েছে, কেন্দ্রীয় সরকার কোনও ক্লাবকে জাতীয় ক্লাব
বলে ঘোষণা করেনি।
মাচাঃ ঠিকই বলেছে। আচ্ছা যদি প্রশ্নটা অন্যভাবে করা যেত। যদি বলা হত,“মোহনবাগান কি ভারতের জাতীয় ক্লাব হিসাবে পরিচিত?”
দেখতিস আর টি আই কোনও জবাব দিতে পারবে না।
লোটাঃ পারবে না তো। মোহনবাগান কি সত্যিই জাতীয় ক্লাব না কি?
মাচাঃ তুই আমার কথার মানেই বুঝিসনি। আর টি আই সেটুকুই জানাতে পারে যা সরকারি নথিতে বা সংবিধানে আছে। তাই ওরা
জানিয়েছে, সরকার কোনও ক্লাবকেই জাতীয় ক্লাব ঘোষণা করেনি। কিন্তু সংবিধানের বাইরে যা আছে, তা নিয়ে আর টি আই কিছু
বলতে পারে না। মোহনবাগান জাতীয় ক্লাব এই কথাটা এতটাই প্রচলিত যে খবরের কাগজ বলে, টি ভি চ্যানেল বলে, ওয়েবসাইট,
উইকিপিডিয়া, লেখক, বিশেষজ্ঞ সবাই বলে। এমন কি ফিফা সভাপতি ব্লাটার মোহনবাগানকে যে চিঠি পাঠিয়েছেন তাতে national
team কথাটা লেখা আছে। এই সার কথাটা তোরাও জানিস। জানিস বলেই মামলা করতে গেছিলিস। কই “ইস্ট বেঙ্গল জায়গাটা
ভারতের কোথায় অবস্থিত” তা নিয়ে তো মামলা করতে যাসনি?
লোটাঃ ভাট না বকে আসল পয়েন্টে আসুন। নিজেই স্বীকার করছেন, সংবিধানে জাতীয় ক্লাব বলে কিছু নেই। তা হলে এটাও স্বীকার
করুন, নিজেদের ওয়েবসাইটে জাতীয় ক্লাব লিখে আপনারা বেআইনি কাজ করেন।
মাচাঃ সে তো তোরাও তোদের ওয়েবসাইটে লিখতিস তোদের স্পনসর SEBI . একটা তদন্তকারী সংস্থা, তারা তোদের স্পনসর হল
কী করে?
লোটাঃ সেটা তো অন্যায় মানছি। কিন্তু আপনাদেরটা তো বেআইনি কাজ।
মাচাঃ কখনওই নয়। আমরা কি বলেছি ভারত সরকার আমাদের জাতীয় ক্লাব বলেছে? শোন, সরকার বা সংবিধানের বাইরেও অনেক
কিছু থাকে। সেখানে আর টি আই অচল। ২০১২ সালে উত্তরপ্রদেশের একটা ১০ বছরের মেয়ে আর টি আই-তে জানতে চেয়েছিল, “
মহাত্মা গান্ধী কি জাতির জনক?” উত্তর আসে, “কোনও সরকারি নথিতে এমন তথ্য নেই।“ কিন্তু সরকার একথা বলেনি যে আজ
থেকে গান্ধিজিকে জাতির জনক বলা নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হল। যার বলতে ইচ্ছা করবে বলবে, ইচ্ছা না হলে বলবে না। মোহনবাগানের
ব্যাপারটাও তাই। তোদের বুদ্ধি দেখছি সেই ১০ বছরের বাচ্চাটার মত।
লোটাঃ বুঝেছি, আপনি ফেসবুক থেকে এই সব এঁড়ে তর্ক শিখেছেন। বলি, গান্ধিজিকে জাতির জনক কে বলেছিল জানেন? সু-ভা-ষ-
চ-ন্দ্র ব-সু। সেই থেকে নামটা চালু হয়েছে।
মাচাঃ আমাদের জতিয় ক্লাব কে বলেছে জানিস? তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী। ১৯৮৯ সালে আমাদের শতবর্ষের অনুষ্ঠানে রাজীব
বলেছিলেন মোহনবাগান জাতীয় ক্লাব।
লোটাঃ নেতাজি সুভাষের সঙ্গে রাজীব গান্ধীর তুলনা! আপনাদের কি মাথা খারাপ হয়েছে?
মাচাঃ আমাদের নয়, তোদের মাথা খারাপ হয়েছে। খারাপ হয়েছে বলেই এটা নিয়ে মামলা করতে যাস। অথচ, আশিয়ান ক্লাব জেতার
পর, তোদের ক্লাবই দাবি করেছিল,ইস্টবেঙ্গলকেও জাতীয় ক্লাব ঘোষণা করতে হবে। বিশ্বাস না হলে পুরানো কাগজ খুলে দেখে নে।
লোটাঃ আচ্ছা আপনাদের কি মনে হয়, আশিয়ান কাপ জেতাটা গর্বের ব্যাপার নয়?
মাচাঃ নিশ্চয়ই গর্বের ব্যাপার। শুধু আশিয়ান কেন? তোরা এ এফ সি-র সেমিফাইনালে গেছিলিস, ইরানের পাস ক্লাবকে হারিয়েছিলিস।
তোদের সমর্থন করি না, কিন্তু এইসব কৃতিত্বের জন্য নিশ্চয়ই বাহবা দিই।
লোটাঃ সেটা আপনি একা দেন। সব মাচা দেয় না। খিস্তি দেয়।
মাচাঃ সেটা তোরাও দিস। ওরে লোটা। কেউ যখন যুক্তিহীন খিস্তি দেয়, তখন জানবি, সে তোর কৃতিত্বকে ঈর্ষা করছে, তাই মুখ
খারাপ করছে। এই যে আমরা তিনটে বড় ক্লাবের সমর্থকরা একে অন্যকে খিস্তি দিই। কেন? কারণ আমরা জানি, আমাদের বিরোধী
ক্লাবের ঝুড়িতেও গর্ব করার মতো অনেক কিছু আছে। এই যে মহামেডান, আজ না হয় সময় খারাপ যাচ্ছে, কিন্তু ব্রিটিশ যুগে ওরা
গোরাদের ত্রাস ছিল। ওরে মুখে যতই গালাগাল দিই, নিজেরা পারলাম না বলে যতই দুঃখ হোক, ভেতরে ভেতরে আমরা কেউ অন্যের
কৃতিত্বকে অস্বিকার করতে পারি না।
লোটাঃ সেটা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। আপনারাও পেলের টিমের সঙ্গে ড্র করেছেন, দুর্ধর্ষ আরারাত ক্লাবকে রুখে দিয়েছেন, এতে
ভারতীয় ফুটবলের মুখই উজ্জ্বল হয়েছে।
মাচাঃ আসল কথাটাই তো বললি না। ১৯১১-র শিল্ড জয়?
লোটাঃ আরে মশাই, ওই টিমে কতজন বাঙাল ছিল জানেন?
মাচাঃ এই কথাটাই তো বলতে চাইছি। ওই টিমে বাঙাল- ঘটি- বামুন- কায়েত- খ্রিস্টান- অল্পশিক্ষিত- অধ্যাপক সব ছিল। এমনকি
ভুতি সুকুল, তিনি আসলে ছিলেন উত্তরপ্রদেশের লোক। আজকের দিনে কথাটা শুনতে সামান্য মনে হয়। কিন্তু তখন দেশ পরাধীন,
প্রবল স্বদেশি আন্দোলন চলছে, সঙ্গে চলছে অসহযোগ- বয়কট, বঙ্গভঙ্গ ব্যর্থ হয়ে গেছে, সেই পরিস্থিতিতে এই টিম ছিল জাতির
প্রতীক। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বলেছিলেন ‘A Nation in Making’, সেই nation মানে জাতির প্রতিফলন ঘটেছিল মোহনবাগানের
মধ্যে। যে জাতি ব্রিটিশের দেখে আর ভয়ে গুটিয়ে থাকবে না।
লোটাঃ ঠিকই বলেছেন। কিন্তু তার পরেও ভারতীয় ফুটবলে অনেক কিছু ঘটেছে। অলিম্পিকে ৪র্থ হয়েছে, এশিয়ান গেমসে সোনা
জিতেছে।
মাচাঃ ওরে পাগল। ভারত যদি বিশ্বকাপ জেতে তাহলেও ওই ঘটনাটা ম্লান হবে না। ভারত বিশ্বকাপ জিতলে সেটা হবে ভারতীয়
ফুটবলের জয়, কিন্তু ১৯১১-র টা ছিল ভারতীয় জাতির জয়। ওটা ছিল স্বাধীনতার লড়াই। আর সেই লড়াইয়ে শুধু ঘটিরা ছিল না,
বাঙালরাও ছিল, যে ফুটবল বোঝে না সেও ছিল। মুসলমানরাও জয়ের আনন্দে ব্যান্ড বাজিয়ে আনন্দ করেছিল।
লোটাঃ তাহলে সেই গর্ব শুধু আপনাদের হবে কেন? সবার গর্ব। বাঙালদেরও গর্ব।
মাচাঃ গর্ব কর না। কে মানা করেছে? শোন, মোহনবাগান ক্লাবটায় কোনও ধর্মের নাম নেই, কোনও ইস্ট ওয়েস্ট নেই, ডেম্পো-
সালগাওকারের মতো কোনও পরিবারের নাম নেই। মাহিন্দ্রা- জে সি টির মতো কোনও কোম্পানির নাম নেই। মোহনবাগানের সমর্থক
হতে বলছি না। কিন্তু ওই ইতিহাসটার সমর্থক হ। ওই ইতিহাসটার জন্যই মোহনবাগান জাতীয় ক্লাব।
লোটাঃ আবার সেই ঘুরে ফিরে গরু রচনায় এসেছে। মোহনবাগান জাতীয় ক্লাব নয়। সংবিধানে নেই।
মাচাঃ আরে সংবিধানে নেই তো কী? মানুষের মনে আছে, ইতিহাসে আছে। সংবিধানে নেই এটা যেমন সত্যি, তেমনি মোহনবাগান
ভারতীয় ফুটবলের প্রতীক, পরাধীন দেশে ভারতীয় জাতির প্রতীক, এটাও সত্যি। আচ্ছা বেশ, national club কথাটায় তোর
আপত্তি থাকলে এবার থেকে বলব, nation’s club . জাতীয় ক্লাবের বদলে বলব জাতির ক্লাব। সেই জাতির মধ্যে তোরাও
থাকবি। এবার খুশি তো, না কি তো এই জাতির মধ্যে পড়িস না?
আরে যাচ্ছিস কোথায়? দুপুর বেলায় এলি ভাত খেয়ে যা।
লোটাঃ দূর তোমাদের এদেশিদের রান্না খাওয়া যায় না কি? তুমি বরং বিকেলে আমাদের বাড়ি এসো…
মাচাঃ ওই দ্যাখ, তুইই কিন্তু এদেশি ওদেশী প্রসঙ্গটা তুললি। রেডি হয়ে থাকিস। বিকেলের ঝগড়াটা এই নিয়েই হবে।