দিব্যেন্দু দে
কাগজে প্রায়ই দেখা যায়, পাত্র চাই। রবিবার এই বিজ্ঞাপনটা একটু বেশিই থাকে। ছেলে বেলায় বুঝতাম না, পাত্র চাই, পাত্রী চাই মানে কী ? ওইভাবে পাত্র চেয়ে যে বিয়ে হয়, বুঝতামই না।
এখনও ওই বিজ্ঞাপন দিব্যি আছে। তবে সোশাল সাইটে যেভাবে অবাধ বন্ধুত্ব হচ্ছে, কতদিন এই সাবেকি ‘পাত্র চাই’ থাকবে, জানি না। আমার লেখার বিষয় অবশ্য পাত্র চাই নয়, মুখপাত্র চাই।
ছাত্রাবস্থায় বাম রাজনীতি করতাম। এখন প্রত্যক্ষ রাজনীতির ত্রিসীমানায় না থাকলেও মনে মনে বামপন্থীই থেকে গেছি। মিছিলে হাঁটতে পারি না। তবে চাই সেই মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হোক। চাই, পতাকাটা পতপত করে উড়ুক। চাই, ভুলভাল লোকগুলো একটু দূরে থাকুক। চাই, দল বিচ্ছিন্নতা কাটিয়ে আবার গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠুক।
কিন্তু কতগুলো ব্যাপার মন থেকে মেনে নিতে পারি না। টিভির সামনে এখনও রোজ বিমান বসু কেন বসবেন ? সিপিএমে কি আর সাংবাদিক সম্মেলন করার লোক নেই ? আগেকার যুগে প্রমোদ দাশগুপ্ত নাকি শুনেছি মুড়ি খেতে খেতে সাংবাদিকদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। সেই দিন আর নেই। আপনার ঘরে সারাক্ষণ চলছে নিউজ চ্যানেল। সকালেরটা আর সন্ধেতে নয়, বড় ইভেন্ট মানেই লাইভ টেলিকাস্ট। দুপুরের প্রেস কনফারেন্স দুপুরেই সরাসরি পৌঁছে যাচ্ছে মানুষের বসার ঘরে।
চারপাশের পৃথিবীটা ক্রমশ বদলে যাচ্ছে। এই পরিবর্তনের সঙ্গে বামপন্থীরা বদলাবেন না ? বিভিন্ন জায়গায় শুনেছি, সোশাল সাইট কীভাবে ব্যবহার করবেন, তা নিয়ে কর্মশালা হচ্ছে। এই মিডিয়ামকে কীভাবে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যায়, তা শেখানো হচ্ছে। কিন্তু গোড়াতেই তো গলদ রয়ে গেছে। প্রেস কনফারেন্সে রোজ যদি বিমানবাবু অবান্তর ও হাস্যকর সব কথা বলেন, তা মুহূর্তে খোরাক হয়ে যায়।
বিমানবাবুর পরিশ্রম বা অনাড়ম্বর জীবন যাপনকে শ্রদ্ধা করি। কিন্তু এটা মানতেই হবে, তিনি মোটেই ভাল কথা বলতে পারেন না। অধিকাংশ বাক্য ঠিকঠাক কমপ্লিট করতে পারেন না। কী বলতে গিয়ে কী বলে বসেন, নিজেও বোঝেন না। ঠিকমতো হোমওয়ার্ক থাকে না। যদি কিছু ভেবেও আসেন, সেটাও ততোধিক বোকা বোকা। বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান এত স্থূল কথা বলছেন, ভাবতেই কেমন লাগে।
সহজ কথা, তাঁকে রোজ প্রেসের মুখোমুখি হতে হবেই বা কেন ? যতই হোক, তিনি বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান। এতখানি সহজলভ্য নাই বা হলেন। কই, সোনিয়া গান্ধী বা অমিত শাহ তো প্রেস মিট করেন না। কোনও এক জুনিয়র সাংবাদিক আপনাকে অবান্তর একটা প্রশ্ন করে বসল, আপনি মেজাজ হারিয়ে ফেললেন উল্টোপাল্টা বলে ফেললেন, এমনটা তো অনেকবারই হয়েছে। প্রশ্নগুলো কী ছিল, তা নিয়ে লোকে মাথা ঘামায় না, আপনার উত্তরটা কী, সেটাই শিরোনাম হয়।
পেশাদারিত্বের যুগ। স্পেশালাইজেশনের যুগ। যে রান্না করে, সে গাড়ি নাই বা চালালো। যে টিভি সারায়, সে ঘর নাই বা মুছল। সব কাজটা সবাইকে দিয়ে হয় না। গুছিয়ে বাগিয়ে ভাল কথা বলতে পারেন, সিপিএমে এমন লোকের তো অভাব নেই। তাঁদের না হয় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বসানো হোক। জেলার নেতারাও যদি মাঝে মাঝে আলিমুদ্দিন থেকে সাংবাদিক বৈঠক করেন, তাহলে সেই জেলায় একটা ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। মহম্মদ সেলিম, সুজন চক্রবর্তী, শমীক লাহিড়ি, মানব মুখার্জিরা বেশ ভাল কথা বলেন। তরুণদের মধ্যে ঋতব্রত, শতরূপরাও চমৎকার বলছেন। তাঁরা তো বসতেই পারেন। জেলার নেতাদের মধ্যে জীবেশ সরকার, সুমিত দে, অমল হালদার, অমিয় পাত্রদেরও কি মাঝে মাঝে প্রেস কনফারেন্সে পাঠানো যায় না ? টিভি চ্যানেলের আলোচনায় শুধু কলকাতার নেতারাই কেন বসবেন ? কই, জেলার নেতাদের তো সেভাবে দেখি না। জেলায় এমন অনেক বাগ্মী নেতা আছেন, যাঁরা কলকাতার নেতাদের চেয়েও সুন্দর কথা বলেন। আরও সুন্দরভাবে তাঁরা দলের অবস্থানকে ব্যাখ্যা করতে পারবেন। বিমানবাবু, শ্যামলবাবুরা বরং কিছুটা আড়ালে থাকুন। এতে তাঁদের গুরুত্ব ও গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। দলকেও বিড়ম্বনায় পড়তে হবে না।
জানি না, এই লেখা বাম নেতৃত্ব পড়বেন কিনা। তবে আমার মতো আরও অনেকের এটাই মনের কথা। টিভির আলোচনায় যখন অংশ নিচ্ছেন, তখন সেখানেও একটা প্যানেল তৈরি হোক। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে জেলার মুখকে তুলে আনুন। শুধু কলকাতার আবর্তে আটকে থাকবেন না। আবার সাংবাদিক সম্মেলনের জন্যও আলাদা প্যানেলের কথা ভাবুন। হ্যাঁ, এটাই পরিবর্তিত পরিস্থিতির দাবি।।