রবি কর
কাকে উদ্দেশ্য করে যে লিখব সেটাই বুঝতে পারছি না। কাকে লিখলে ফল হবে? কে নিজেকে সংশোধিত করার চেষ্টা করবে? আর কে আমাকে জগ ছুঁড়ে মারবে? বুঝতে পারছি না। কখনও মনে হচ্ছে উপাচার্যকে লিখি। কখনও মনে হচ্ছে ছাত্রনেতাকে লিখি। কখনও মনে হচ্ছে শিক্ষামন্ত্রীকে লিখি।
শিক্ষামন্ত্রীকে লেখা না লেখা অবশ্য সমান। কথায় আছে বিদ্যা দদাতি বিনয়ম। অর্থাৎ বিদ্যা বিনয় দান করে। শিক্ষামন্ত্রী ডক্টরেট করলেন,মানে বিদ্যা বাড়ল। ভাবলাম এবার হয়তো বিনয়টাও… কিন্তু নাহ। উলটে তিনি বললেন, মাইনে আমি দিই। তাই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের আভ্যন্তরিন ব্যাপারে তিনি হস্তক্ষেপ করবেনই। অর্থাৎ তিনি প্রভু। শিক্ষক- অধ্যাপকরা চাকরবাকর।
ওঁকে কিছু লিখে লাভ নেই। তাই তোমাকে লিখছি। বয়সে ছোট তাই তুমি বলছি। নইলে যার সামনে উপাচার্য কেঁচো হয়ে থাকে, তাঁকে ‘আপনি’ ’আজ্ঞে’ করাই উচিত। তুমি বলছি বলে রাগ করো না যেন। তোমাদের রাগকে আমি বড় ভয় পাই। তাই সরাসরি তোমার নাম নিচ্ছি না। ইঙ্গিতে বলছি। তুমি ছাড়া কেউ তোমার পরিচয় বুঝতে পারবে না।
তুমি হলে সেই তুমি হলে সেই ছাত্র যে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে দলবল নিয়ে অধ্যাপকদের সামনে তালি বাজাচ্ছিলে। কেন বাজাচ্ছিলে জানি না। আমি মুখ্যু মানুষ। শুনেছি, কারও বাড়িতে বাচ্চাকাচ্চা হলে এক শ্রেণির মানুষ তালি বাজাতে আসে। যতদুর জানি বিশ্ববিদ্যালয়ে কারও বাচ্চাকাচ্চা হয়নি। আর তুমিও ওই শ্রেণির মানুষ নও।
তাই তোমাকে বরং তালিবান বলেই ডাকি। যে দয়া করে সে দয়াবান। যে তালি দেয় সে তালিবান। আর কী আশ্চর্য আরবি ভাষায় তালিবান মানে ছাত্র। তাহলে ছাত্রনেতা আর তালিবান নেতা একই হল, কি বল? আমি আশাবাদী যে, তুমি এবং তোমার সাঙ্গপাঙ্গরা অচিরেই বাংলার তালিবান নামে ইতিহাসে স্থান লাভ করবে। কারণ, এমন শিক্ষাঙ্গনে এমন রুচিহীন, শিক্ষাহীন, ভদ্রতাহীন আচরণ একমাত্র তালিবানরাই করে।
তবে মুশকিল হল, শিক্ষামন্ত্রীর মতই তোমাকেও এসব কথা লেখা না লেখা সমান। কারণ তালিবান এবং তাদের উস্কানিদাতারা কখনও কিছু পড়ে না। পড়লেও বোঝে না।
তাই আপনাকেই লিখছি স্যার। আপনার মতো পণ্ডিত এই রাজ্যে কেন, এই দেশেই খুব কম আছে। আপনি হয়তো সময় করে, এই লেখাটা পড়বেন।
আপনার bio-data দেখলে স্যার মাথা ঝিমঝিম করে। আপনার qualification, experience, research,লেখালেখির তালিকা এতটাই বড় যে আমি মুখস্থ করে উঠতে পারিনি। তাই লিখতেও পারছি না। শুধু এটুকু বলতে পারি দেশবিদেশের ডিগ্রি, নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান, অসংখ্য মূল্যবান লেখালেখি দেখে আফসোস হয়েছে, যদি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেতাম, সবাইকে বলতে পারতাম আমি আপনার ছাত্র।
মানুষ হিসাবেও আপনি ভদ্র, বিনয়ী। বছর খানেক আগে শোরগোল ফেলে দেওয়া অন্য এক উপাচার্যের মতো আপনি উদ্ধত নন। বিদ্যা দদাতি বিনয়ম প্রবাদটি আপনার শরীরী ভাষায় ফুটে ওঠে।
কিন্তু স্যার, ধৃষ্টতা মাপ করবেন, বিনয় মানে কি প্রবলের সামনে গুটিয়ে থাকা ? কথায় আছে, ফলন্ত বৃক্ষের শাখা যেমন ফলভারে নুয়ে পড়ে, বিদ্বান ব্যক্তি তেমনই বিদ্যার ভারে নুয়ে থাকেন। কিন্তু স্যার, নুয়ে থাকা মানে কি ভূমিশয্যা নেওয়া ?
আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে আপনার সামনে যখন তালি দিতে দিতে তালিবানরা তাণ্ডব চালাচ্ছিল, আপনার উচিত ছিল না সামনে এসে দাঁড়ানো ? আপনার উচিত ছিল না, তালিবানের পাণ্ডাটার গালে সপাটে একটা চড় মারা ?
আমি যে গ্রামের স্কুল থেকে পাশ করেছি, সেখানকার মাস্টারমশাইরা আমাদের উত্তমমধ্যম পেটাতেন। আমরা জানতাম শিক্ষক পিতৃতুল্য। মারতেই পারেন। আপনার ছাত্ররা, মন্ত্রীরা না হয় শিক্ষকদের চাকরবাকর ভাবেন, তাবলে আপনিও সেই ভাবনায় গা ভাসাবেন ? দুঃখজনক, নজিরবিহীন বলে একটা মিনমিনে বিবৃতি দিয়ে দায় সারবেন ?
আপনি যদি কড়া হতেন কী হত ? আপনার গায়ে পাল্টা হাত উঠত ? আপনার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হত ? অত সহজ নয় । আপনার বিশ্ববিদ্যালয় আজও ভারতের অন্যতম সেরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান । একসময় দুনিয়াজোড়া তার খ্যাতি ছিল। আপনার কিছু হলে তার প্রতিক্রিয়া সামলানো সরকারের পক্ষে সহজ হত না।
আর কিছু না পারুন পদত্যাগ তো করতে পারতেন ? বলতে তো পারতেন, আমার ছাত্রদের আমি মানুষ করতে পারিনি। আমার ব্যর্থতাতেই তারা তালিবান তৈরি হয়েছে, আমার সহকর্মীদের আমি নিরাপত্তা দিতে পারিনি, এর পর এই পদে থাকতে আমি ইচ্ছুক নই।
যদি বলতে পারতেন স্যার, আপনার bio-data-য় নতুন একটা কীর্তি যোগ হত। ইতিহাস আপনাকে মনে রাখত। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বলত, উপাচার্য মহাশয় শুধু বিদ্বান ছিলেন না, যথার্থ শিক্ষকও ছিলেন। তালিবানদের পাণ্ডাটাকে এমন থাবড়া মেরেছিলেন যে সেই আঘাত তাদের মদতদাতাদের গালে গিয়ে লেগেছিল।