বিজ্ঞাপনের বন্ধুত্ব! ফাঁদে পা দেবেন না

আগস্টের প্রথম রবিবার। বিশ্ব বন্ধুত্ব দিবস। কাগজে বন্ধুত্বের নানা লোভনীয় বিজ্ঞাপন। তার আড়ালে আসলে কী ? জানতে গিয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘুরে এলেন। অনেক অজানা কথা লিখলেন সংহিতা বারুই।

কেউ স্কুলের বন্ধু , কেউ পাড়ার ।কেউ কলেজের তো কেউ টিউশনির । বর্তমানে তো ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ আর কত কিছুর মাধ্যমে বন্ধুত্বের পরিসর বেড়ে চলছে । চাকরিতে ঢুকলে অফিসে একদল বন্ধু । ডেলি প্যাসেঞ্জার হলে ট্রেনে বাসেও বন্ধু জুটে যায়। জীবনের নানা বাঁকে কত বন্ধু আপনার জন্য অপেক্ষা করে আছে । তবু আমাদের মন ভরে না। আমরা নিত্য নতুন বন্ধু খুঁজতে ব্যস্ত থাকি।
এক সময় পত্রমিতালির খুব চল ছিল। চিঠি লিখে কত অজানা বন্ধু পাওয়া যেত। তারপর এল নেট। অর্কুট, ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ- মজে গেল এই প্রজন্ম । হারিয়ে যাওয়া কত বন্ধুত্বের হদিশ দিল এই সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ।অফিসের কাজ চুলোয় । বাড়ির ফিরেও নেট মুখো। কেউ কেউ সামনে মোবাইল খচখচ করে চলেছে । সবাই ব্যস্ত বন্ধুত্বকে ঝালিয়ে নিতে।

abc
কিন্তু এখানেই থেমে থাকা নয় । বন্ধুত্ব আরও এক নতুন চেহারা নিয়ে হাজির। মাঝে মাঝেই কাগজে হয়ত পত্রমিতালির বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। না, চিঠি পত্রের কোনও পাঠ নেই । সেসব পাঠ তো কবেই উঠে গেছে। এখন বন্ধুত্ব সরাসরি হাজির শরীরের হাতছানি নিয়ে । কোনও লুকোছাপাও নেই। একেবারে সোজাসাপটা চলছে বন্ধুত্বের নামে শরীর দেওয়া নেওয়ার কারবার। কী কী থাকে সেই বিজ্ঞাপনে ? আসুন , বয়ানগুলিতে একবার চোখ বোলানো যাক ।
(১)ঠকবার ভয় নেই , হাই / মিডিয়াম প্রোফাইল বন্ধুর সঙ্গে ফ্রেন্ডশিপ/ ক্লোজ রিলেশনের করুন।
(২) ক্লোজ রিলেশনের মাধ্যমে উপার্জন করে মনের উচ্চাকাঙ্ক্ষা , স্বপ্ন পূরণ করুন।
(৩) আপনি কি নিঃসঙ্গ একাকীত্বে ভুগছেন / প্রকৃত বন্ধুর দ্বারা ভালোবাসা পেতে ও একাকীত্ব দূর করুন সরাসরি অফিসে আসুন। বিশ্বাস ও গোপনীয়তার সঙ্গে মনের ইচ্ছা পূরণ করে বন্ধুত্ব করুন। সব জেলায় সঠিক পরিষেবা । ইনকামের গ্যারান্টি। স্পেশাল অফার চলছে।
(৪) স্পর্শ , বন্ধুত্বের ছোঁয়া। চাহিদামতো পরিষেবা । খোলা মনে বন্ধুত্বের সম্পর্কের জন্য ।
(৫) জীবনের নিঃসঙ্গতা ও একাকীত্ব দূর করতে ফোন করুন।
(৬) সুইট ফ্রেন্ড । সত্যিকারের বন্ধুত্ব এবং রঙিন সম্পর্কের একমাত্র ঠিকানা। প্রতিটি জেলায় সার্ভিস।
এমন আরও নানা বয়ান । সঙ্গে ফোন নম্বর। বিজ্ঞাপনের ভাষা যাই হোক, সঠিক পরিষেবা বলতে কী বোঝানো হচ্ছে, তা সবাই বোঝে । তবু মনে হল , একটু যাচাই করেই দেখা যাক । যোগাযোগ করলাম ধর্মতলা চত্বরের এমন একটি সংস্থার সঙ্গে। মহিলা শুনেই উৎসাহ যেন বেড়ে গেল। জানিয়ে দিলেন, আপনার কোনও খরচ লাগবে না। কোনও রেজিস্ট্রেশন ফি লাগবে না । বরং বাড়তি কিছু আয় করতে পারেন। আপনার জীবন বদলে যাবে । চলে আসুন। কিছুটা দ্বিধা ছিল। ভয়ও ছিল । তবু গেলাম । একজন রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল । সে ভাল করে দেখে নিল। তারপর নিয়ে গেল একটা গলির ভেতর ।

ছোট্ট একটা অফিস। এক মহিলা সেখানে বসে। বেশ সুন্দরীই বলা যায় । কথা বার্তাও বেশ গোছানো। জানতে চাইলেন, কেন বন্ধু খুঁজছি। কী বলব , মোটামুটি তৈরি হয়েই গিয়েছিলাম। বললাম , আরও কিছু উপার্জন করতে চাই। এবার সেই মহিলা বুঝিয়ে দিল কী কী করতে হবে। প্রথমেই একটি ফর্ম ফিলাপ। সেখানে নিজের নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর লিখতে হবে। লিখতে হবে বয়স, ওজন , উচ্চতা । জমা দিতে হবে ছবি। আমি অবশ্য ছবি জমা দিইনি। তবে ঠিকানা দিয়েছিলাম পুরোটাই ভুল। সেই মহিলা বলল , বাড়ির অনুমতি আছে তো! আমি বললাম, এসব কাজ কি কেউ বাড়িতে জিজ্ঞেস করে নাকি? আপনিই কি বাড়িতে সত্যি কথা বলে এই চাকরিটা করতে এসেছিলেন ? তখন সেই মহিলা আরও প্রশ্ন করতে লাগল। আগে কখনও শারীরিকভাবে কারও সঙ্গে মিলিত হয়েছি কিনা, বাইরে যেতে আপত্তি আছে কিনা । বানিয়ে বানিয়ে যা যা বলার বললাম।
কী রকম টাকা পাওয়া যেতে পারে? কীভাবে কাজ হয়? কিছুটা আভাস পাওয়া গেল। কারা নেই এই তালিকায়? কলেজে ছাত্রী থেকে গৃহবধূ, ডাক্তার থেকে শিক্ষিকা , বিধবা থেকে ডিভোর্সি । শারীরিক তৃপ্তিও হল , আবার বাড়তি উপার্জনও হয়ে গেল। অভাবের তাড়নায় নাম লেখাচ্ছে, এমন সংখ্যাও কম নয়। আর পুরুষদের মধ্যে! সেখানে উচ্চ পদস্থ আমলা থেকে সরকারি চাকুরে, ব্যবসায়ী থেকে প্রমোটার । পুলিশি ঝামেলা? ওই সংস্থাই আপনাকে আশ্বস্ত করবে , ওসব ভয় পাবেন না । আমরা নানা জায়গায় মাসোহারা দিই । কিচ্ছু হবে না।
মূলত, টাকা আদায় হয় ছেলেদের কাছ থেকেই। কেউ যে নির্ভেজাল বন্ধুত্বের জন্য ফোন করেছে না , এটা সবাই বোঝে। শুধু দেখে নেওয়া হয়, কার সামর্থ্য কেমন । যেমন টাকা ফেলবেন , তেমন সুন্দরী পাবেন। প্রথমেই নাম রেজিস্ট্রেশন করতে হবে। তার জন্য কোথাও লাগে ১১০০ টাকা, কোথাও আড়াই হাজার। এরপর দফায় দফায় ‘পরিষেবার’র জন্য আলাদা খরচ তো আছেই । জানতে চাওয়া হবে, কী রকম বন্ধু তাঁর পছন্দ । কলেজ ছাত্রী নাকি গৃহবধূ , স্লিম নাকি মোটা , সবরকম ব্যবস্থাই আছে। দেখানো হবে ক্যাটালগ। কার কী রেট , তাও জানিয়ে দেওয়া হবে। রেটে পোষালে ভালো, নইলে কম রেটে চেষ্টা করুন। কোথাও কোথাও দরাদরি, আবার কোথাও ফিক্সড রেট। সবকিছু বোঝা হল।
friendship day2
এখানেও নানা প্যাকেজ। কয়েক ঘণ্টার জন্য সান্নিধ্য চান , নাকি সারাদিনের জন্য নিয়ে যেতে চান? দিন পাঁচেকের জন্য বাইরে নিয়ে যেতে চান? সব রকম ব্যবস্থাই আছে । খরচ? দিন পিছু কুড়ি হাজার থেকে এক লাখ। তার একটা অংশ পায় ওই বন্ধুত্ব কারি সংস্থা, আর একটি অংশ সেই নাম লেখানো মহিলা। একবার নাম লেখালে আর নিস্তার নেই। ওই সংস্থার কথাই আপনাকে শুনে চলতে হবে। কখন কোন ক্লায়েন্টের কাছে যেতে হবে, তা ওই সংস্থার কথাই আপনাকে শুনে চলতে হবে। কখন কোন ক্লায়েন্টের কাছে যেতে হবে, তা ওই সংস্থাই বলে দেবে । বাড়িতে বা পাড়ার মোড়ে গাড়ী গিয়ে তুলে আনবে। আবার ছেড়েও আসবে। তাদের কথা মতো চললে সমস্যা নেই। কিন্তু না শুনলেই নেমে আসবে নানা বিপর্যয় । আপনার বাড়ির ঠিকানা তো জানাই আছে। আপনি হয়ত শুধু নিজের নম্বর টুকুই জানিয়েছেন, কিন্তু আপনার বাবা বা স্বামীর নম্বর তাদের কাছে ঠিক পৌঁছে গেছে। কীভাবে জোগাড় করে , তারাই জানে। হোটেলে বা অন্য কোথাও কখন যে আপনি ক্যামেরা বন্দী হয়ে গেছেন, আপনি নিজেও জানেন না । সেই সব গোপন মুহূর্তের ছবি সযত্নে সামলে রাখে এই সংস্থা গুলি। যখনই আপনি তাদের কথার খেলাপ করবেন , তখনই আস্তে আস্তে ব্ল্যাকমেলিংয়ের শিকার হবেন। আপনার স্বামীর মোবাইলে হয়ত ফোন আসবে। কেউ হয়ত বাড়িতে ডাকতেও চলে আসবে। তাতেও কাজ না হলে এম এম এস করে সেসব ছবি নানা জায়গায় পৌঁছে দেওয়ার হুমকিও থাকবে। অর্থাৎ , নিজের ইচ্ছেয় নাম লেখানো যায়, কিন্তু বেরিয়ে আসার রাস্তাটা আপনার জানা নেই।
এমন অনেক মহিলাই আছে , যারা বিয়ের আগে কিছু প্রলোভনে হয়ত নাম লিখিয়েছিল কিন্তু বিয়ের পর, ইচ্ছা না থাকলেও তাদের কাজ করে যেতে হচ্ছে। এমনকি গর্ভবতী অবস্থাতেও আপনার ছাড় নেই । তখনও ছুটতে হবে গ্রাহককে ‘পরিষেবা’ দিতে । চাইলেও বেরিয়ে আসার উপায় নেই। শোনা যায়, এই ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আস্তে না পেরে দুএকজন আত্মহত্যাও করেছে। আরও যেসব তথ্য বেরিয়ে এল তা মারাত্মক। শালীনতার কারণে সেগুলো লেখা উচিত হবে না । সবকিছু এত খোলামেলা। সব কিছুই হচ্ছে একেবারে প্রকাশ্যে, দিনের বেলায়। সব আর্থিক লেনদেন হয় প্রথম সারির রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাঙ্কের মাধ্যমে। অথচ কারও কিছু করার নেই! কেউ কেউ বিজ্ঞাপনে দাবি করে সরকারি স্বীকৃত । চোখের সামনে কর্পোরেট কায়দায় অবাধে চলছে দেহ ব্যবসার র্যা কেট। কাগজে থাকছে ঢালাও বিজ্ঞাপন । কোনও কিছুই পুলিসের নজরে পড়ছে না ! মাঝে মাঝে একবার মধুচক্রে হানা! ব্যাস , এখানেই দায়িত্ব শেষ । সেই ট্রাডিশন চলতেই থাকে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.