ক্ষমা চাইছি
তিমিরকান্তি পতি, খাতড়া, বাঁকুড়া
গ্রামের স্কুলের পাঠ শেষ করে সবে স্থানীয় হাড়মাসড়া হাইস্কুলে ক্লাস ফাইভে ভর্তি হয়েছি। বেশ কয়েকদিন নতুন স্কুলে ক্লাসও করেছি। তবুও সবার সাথে তখনও আলাপই হয়নি। গ্রামের বন্ধু বিধান, চণ্ডী, সোমনাথ, জয়ন্ত আর কাঞ্চন। এদের সাথেই স্কুল বা গ্রামে নিত্য ওঠাবসা। মানে যাকে বলে অন্তরঙ্গ বন্ধু। এদের মধ্যে বিধান আর সোমনাথ হল একটু ‘দাদা’ গোছের। মানে, সব ব্যাপারেই এরা ‘দাদাগিরি’ করতে অভ্যস্ত। সেই ছোটবেলা থেকেই।
এবার আসল কথায় আসি। নতুন স্কুলে বেশ কয়েকদিন ক্লাস করার পর হঠাৎ একদিন আবিস্কার করি আমার ব্যাগে কলমটাই নেই। কলমটা গ্রামের স্কুলের মাষ্টার মশাইয়ের দেওয়া। অনেক খোঁজাখুঁজির পর আমার ব্যাগে কলমটা না পেয়ে বন্ধু বিধানকে বলি। বিধান তো শোনা মাত্রই বলে কলম নিশ্চয় এই ক্লাসেরই কেউ নিয়ে নিয়েছে। ওর কথাতে সহমত প্রকাশ করল সোমনাথ, চণ্ডী আর কাঞ্চনও । যেই ভাবা, সেই কাজ। সবার ব্যাগ দেখা হবে। সিদ্ধান্ত সোমনাথের। আর একে একে সব ছাত্রের ব্যাগ দেখার মধ্যেই সেই কলম পাওয়া গেল এক আদিবাসী ছাত্রের কাছে। কলম পাওয়া মাত্রই যুদ্ধ জয়ের আনন্দ বিধানদের চোখে মুখে। ছেলেটি কাঁদতে কাঁদতে বলছে না, আমি কারও কলম নিইনি। কলমটা আমার। কে শোনে কার কথা! এক ঝটকায় ওর কাছ থেকে কলমটা ছিনিয়ে নিয়ে তুলে দিল আমার হাতে। হারানো কলম ফিরে পেয়ে খুশি আমিও।
ছেলেটা তখনও সমানে কেঁদে চলেছে। আমার বন্ধুদের হুমকি– ‘বেশি বাড়াবাড়ি করলে হেডস্যারকে বলে দেব’। সেই মুহূর্তে পরবর্ত্তী ক্লাসের শিক্ষক চলে আসায় ঘটনাটার আপাত যবনিকা ঘটে। এর পর স্কুল ছুটির পর আমরা যে যার মতো বাড়ি চলে যাই। পরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পড়তে বসেছি। পড়তে বসে দেখি আমার কলমটা তো বাড়িতেই আছে! মানে কলমটা আমি স্কুলে নিয়েই যাইনি। তখনই সিদ্ধান্ত নিই কলমটা কাল স্কুলে গিয়ে ওই ছেলেটিকে ফেরত দেবো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ছেলেটি পরদিন আর স্কুলে আসেনি। এভাবে এক-দুই-তিন দিন…হাফ ইয়ারলি-অ্যানুয়েল পরীক্ষা হল । আমরা ক্লাস সিক্সে উঠে গেলাম। ছেলেটি আর স্কুলে এল না। লজ্জায় না সংকোচে জানি না সেই বয়সে এই কথাটা আমার বন্ধুদের কাছে বলতে পারিনি। আজ বেঙ্গল টাইমসের ওপেন ফোরামে সুযোগ পেয়ে অনেক দিনের জমানো কথাটা সবার সাথে শেয়ার করলাম। ধন্যবাদ বেঙ্গল টাইমস্। আর একই সাথে ক্ষমা চাইছি হারিয়ে যাওয়া সেই সহপাঠী বন্ধুটির কাছে।
(ই মেলঃ timir.pati@gmail.com)
(এই বিভাগ পাঠকদের মুক্তমঞ্চ। আপনিও আপনার মনের ভেতর জমে থাকা কথা বলে কিছুটা হালকা হতে পারেন। মনে রাখবেন, ভুল স্বীকার করতে গেলেও একটা সততা লাগে। ভুল স্বীকারের মধ্যে অন্যায় নেই। আপনার জীবনে এমন কোনও ঘটনা ঘটে থাকলে প্রকাশ করুন বেঙ্গল টাইমসের মাধ্যমে। দেখুন, অনেকটা হালকা লাগবে। লেখা পাঠানোর ঠিকানাঃ bengaltimes.in@gmail.com)