নিঃশব্দে হারিয়ে গেলেন এক বনস্পতি

স্বরূপ গোস্বামী

 

নিজেই মাঝে মাঝে বলতেন, মৃত্যুরও দিনক্ষণ আছে। ঠিক দিন বাছতে হয়। কত বড় বড় মহাপুরুষ এমন দিনে চলে গেছেন, কাগজে জায়গাই পায়নি। পেলেও ভেতরের পাতায়, ছোট করে। কর্মজীবনের নানা উদাহরণ টেনে আনতেন। কে জানত, অমিতাভ চৌধুরি নিজেও দিন বাছতে এমন ভুল করবেন!

একে রাজ্যে পুরভোট আর তার রেজাল্ট নিয়ে হইচই। তার উপর পয়লা মে কাগজ বন্ধ। তিনি চলে গেলেন ৩০ এপ্রিল। পরের দিন কাগজ নেই। তারপর দিন একসঙ্গে দুদিনের খবরের চাপ। সবমিলিয়ে প্রায় হারিয়েই গেলেন খবরের দুনিয়ার কিংবদন্তি। প্রায় সব কাগজেই তিনি দেড়শো শব্দের একটা কপি। তাও কোন পাতায় ছাপা হল, কারও চোখেও পড়ল না। একমাত্র কিছুটা গুরুত্ব পেয়েছে আজকালে। পাওয়ারই কথা। শুধু সেখানে কিছুদিন যুক্ত ছিলেন বলে নয়, শুধু সেখান থেকে কিছু বই বেরিয়েছে বলে নয়, কৃতী মানুষদের প্রয়াণে তাঁদের শ্রদ্ধা জানানোর সদিচ্ছাটা একমাত্র আজকালই দেখায়, এখনও।

মনে পড়ছে, মতি নন্দীর কথা। যে প্রতিষ্ঠানে এত বছর কাজ করেছেন, সেই আনন্দবাজারে বেরিয়েছিল শুধু মৃত্যু সংবাদটুকু (যেন সেটুকু ছেপে ধন্য করলেন)।  এই অমিতাভ চৌধুরির ক্ষেত্রেও সেই এক উদাসীনতা। ঘরোয়া আড্ডায় বলতেন, আমরা লোককে নিয়ে আট কলাম লিখব। কিন্তু আমরা যেদিন চলে যাব, সেদিন সিঙ্গল কলামও জুটবে না। এই রসিকতাটা যে তাঁর জীবনেও এমন নির্মম হয়ে নেমে আসবে, কে ভেবেছিল! জীবনের সেরা সময়টা কাটিয়েছেন আনন্দবাজারে। যেমন তেমন কর্মী নয়, নিউজ এডিটর হিসেবে। শুধু তাই নয়, প্রতিষ্ঠানকে এই উচ্চতায় আনার পেছনে সবথেকে বেশি যে কয়েকটা লোকের অবদান, প্রথম পাঁচের মধ্যে রাখতে হবে এই অমিতাভ চৌধুরিকে। বাংলা সাংবাদিকতাকে ঝরঝরে ভাষা এনে দিলেন যে মানুষটা, বাংলা সাংবাদিকতাকে একধাক্কায় অনেকটা সাবালক করলেন যে মানুষটা, তাঁর মৃত্যুতেও কী অদ্ভুত এক নীরবতা!

amitabha choudhury2

কী হিসেবে মনে রাখতে চান অমিতাভ চৌধুরিকে ? কোন দিকটা ছেড়ে কোন দিকটায় আলো ফেলবেন ? একই মানুষ। এত ভিন্ন সত্তার স্রোত! বাংলা সাংবাদিকতার একমাত্র পদ্মশ্রী তিনিই। সাংবাদিকতার দিকটায় না হয় পরেই আসছি। বাংলা ভাষায় রবীন্দ্রনাথ নিয়ে এমন সিরিয়াস কাজ আর কজন করেছেন ? প্রশান্তকুমার পাল ছাড়া  রবীন্দ্র-জীবনী নিয়ে এমন গবেষণা কে করেছেন!  এমন এমন দিক তুলে এনেছেন, যা তিনি তুলে না আনলে বাঙালির অজানাই থেকে যেত। একটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলি। নয়ের দশক। সাংবাদিকতার ছাত্র। এখান ওখান বিভিন্ন সভা-সমিতিতে চলে যেতাম। বাংলা আকাদেমির একটি অনুষ্ঠান। রবীন্দ্র বিষয়ক বই প্রকাশ। এক বক্তা টেনে আনলেন সুকান্ত ভট্টাচার্যর কথা। তার ভাষা, বিন্যাস, চিন্তা নাকি অনেক মৌলিক। সেখানে ছিলেন অমিতাভ চৌধুরি। তিনি জানতে চাইলেন, ‘ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়, পূর্ণিমা চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।’ লাইনগুলো কার ? সবাই বললেন, সুকান্তর। অমিতাভ চৌধুরি সবাইকে চমকে দিয়ে বললেন, এটা রবীন্দ্রনাথের। সুকান্তের জন্মেরও আগে জাহাজ থেকে লেখা এক চিঠিতে তিনি পূর্ণিমা চাঁদের বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি ক্ষুধার্ত মানুষের কাছে তা রুটির মতোই, এই কথা লিখেছিলেন। সেটা না পড়লে সুকান্তের পক্ষেও এই লাইন লেখা সম্ভব ছিল না। লাইনগুলো বলে গেলেন। কোন কবির কোন কবিতা, কোন গানের কোন অংশটুকু তাঁর সুর থেকে নেওয়া, বলে গেলেন। আধঘণ্টার সেই ভাষণে যেন পিন পড়লেও আওয়াজ শোনা যাবে। রবীন্দ্রনাথ আমাদের সবকিছুর সঙ্গে এভাবে মিশে আছেন, আমরা নিজেরাই জানি না! এমন প্রাঞ্জল ভাষায় কে বলতে পারতেন, তিনি ছাড়া।

ঠিক তার কয়েকদিন পর, মাস মিডিয়া সেন্টারে পেয়ে গেলাম দুর্মূল্য এক বই। সংবাদের নেপথ্যে। সেই বই আর ছাপা হয় না। এমনকি স্বয়ং অমিতাভ চৌধুরির কাছেও নেই। কী অসাধারণ একটা বই! যারা পড়ল না, তারা জানল না, কী হারাল ! ঘটনার আড়ালে কত অজানা ঘটনা। কেন যে এই বই রিপ্রিন্ট হয় না!

টুকটাক আলাপ ছিল। ব্যস, ওই টুকুই। উনি যে পাড়ায় থাকতেন, সেই রাণীকুঠির কাছেই আমার কলেজ। মাঝে মাঝেই রাণীকুঠিতে নামতাম। ওই আবাসনের দিকে তাকাতাম। আমার কাছে ওই আবাসনের একটাই পরিচয় – এখানে অমিতাভ চৌধুরি থাকেন। খুব সম্ভ্রম নিয়ে তাকিয়ে থাকতাম। কিন্তু বাড়িতে নক করার সাহস হয়নি কোনওদিন।

মাঝে মাঝে আজকাল-এর খেলা পত্রিকার দপ্তরে যেতাম লেখা দিতে। দেখতাম, বাইরে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছেন এই কিংবদন্তি মানুষটি। তাঁকে ঘিরে অনুরাগীদের একটা বৃত্ত। সেই বৃত্ত ভেদ করে ঢোকার সাহস কখনও হয়নি। দূর থেকেই দেখতাম, আর মুগ্ধ হতাম। তারপর আজকালে পাকাপাকি যখন প্রবেশ করলাম, তার ঠিক একবছর আগেই তাঁর প্রস্থান হয়ে গেছে। তবু লোক মুখে মুখে ফিরত ‘অমিত’দার কথা। আমি অবশ্য কোনওদিন অমিতদা বলতে পারিনি। কী করে বলব ? স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য যাঁকে ‘অমিতকাকা’ বলেন, আমি তাঁকে ‘দাদা’ বলি কোন লজ্জায়!

কিন্তু তাঁর বাড়ি যাওয়ার সুযোগ হল। আমি তখন একটা ম্যাগাজিনের বার্তা সম্পাদক। ভাবলাম, সুচিত্রা সেনকে নিয়ে একটা ধারাবাহিক লেখা হলে কেমন হয় ? সেই লেখা অমিতাভ চৌধুরির থেকে ভাল কে লিখতে পারেন ? এডিটর মশাইকে বললাম। এককথায় রাজি। তিনিও যুগান্তরের প্রাক্তন সৈনিক, গৌতম ঘোষ। অমিতাভ চৌধুরির আন্ডারে কাজ করেছেন। তাই একটা শ্রদ্ধা তো ছিলই। একদিন ফোনে কথা বলে চলে গেলাম। কথা ছিল নটায়, গেলাম নটা পনেরোয়। গিয়ে বললাম, সরি, একটু দেরি হয়ে গেল। মুখের উপর বলে দিলেন, একটু নয়, অনেক দেরি। পনেরো মিনিট মানে অনেক সময়। সময়ের মূল্য বুঝলেন না।

প্রথমেই কড়া কথা দিয়ে শুরু। অবশ্য একটু পরে মিষ্টিও এল। সাহস করে কথাটা পেড়েই ফেললাম, ‘সুচিত্রা সেনকে নিয়ে একটা ধারাবাহিক করতে চাই। আমরা চাই, আপনি লিখুন। কারণ, সুচিত্রা সেনকে এত কাছ থেকে আর কেউ দেখেননি। যে কয়েকজনের জন্য সুচিত্রার বাড়ির দরজা সব সময় খোলা থাকে, আপনি তাঁদের একজন’। মাঝপথেই থামিয়ে দিলেন। বুঝিয়ে দিলেন, আর প্রশস্তির দরকার নেই। বললেন, ‘বয়স হচ্ছে তো, সব মনে নেই। তাছাড়া হাত কাঁপছে। কলম ধরতেও পারি না।’ বললাম, ‘আপনি বলে যাবেন, আমরা লিখে নেব।’ আমাদের কী ধৃষ্টতা! অমিতাভ চৌধুরির মতো কিংবদন্তী সাংবাদিককে বলছি, ‘আপনার লেখা আমরা লিখে নেব।’ ঠোঁটের কোনে বাঁকা হাসি। কী জানি, তিনিও হয়ত তেমনটাই ভাবছেন। ঠিক হল, আমরা প্রশ্ন করব, উনি উত্তর দেবেন। কিন্তু বারবার খেই হারিয়ে যায়। সুচিত্রা থেকে চলে যান বসন্ত চৌধুরি বা বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিতে । কখনও ইন্দিরা গান্ধী, কখনও হেমন্ত মুখার্জি, সেসব শুনতে ভালও লাগত। বেলা গড়িয়ে যেত। ‘সংবাদের নেপথ্যে’ ছাড়াও তাঁর আরও সাত আট খানা বই পড়াই ছিল। ফলে মাঝে মাঝে কিছু ঘটনা মনে করিয়ে দিতাম। বেশ খুশিই হতেন, ‘এই তো, জানেন দেখছি।’ তারপর থেকে তিনি বলে যেতেন।

suchitra4

পাঠকদের জন্য দু একটা টুকরো টুকরো ঘটনা তুলে ধরা যাক। সবাই জানতেন, তিনিই সুচিত্রা সেনের সবথেকে কাছের বন্ধু। অথচ, তিনি সুচিত্রার দু-তিনটের বেশি ছবিই দেখেননি। সুচিত্রার সঙ্গে তাঁর আলাপটা অদ্ভুতভাবে। তিনি তখন যুগান্তরের বার্তা সম্পাদক। উত্তম কুমার মারা গেছেন। এক প্রতিনিধিকে পাঠালেন সুচিত্রার বাড়িতে। কিন্তু সুচিত্রা ফিরিয়ে দিলেন। লোক মারফত বলে পাঠালেন, তিনি কারও সঙ্গে কথা বলবেন না। সেই রিপোর্টার ফিরে আসতেই তাঁকে প্রচন্ড ধমক দিলেন, ‘সুচিত্রা দারোয়ানকে দিয়ে বলে পাঠাল, আর সেটা শুনে তুমি চলে এলে! কাল বাঙালি কার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইবে ? আমার কাগজে সুচিত্রার কোনও মন্তব্য থাকবে না ?’ রাতের বেলায় নিজেই ফোন করে বসলেন সুচিত্রাকে। ধরলেন অন্য একজন। নিজের পরিচয় দিয়ে কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন, ‘রাগ অভিমানের অনেক সময় পাবেন। কিন্তু আজ যদি উনি কথা না বলেন, তাহলে সেটা হবে চরম অন্যায়। উত্তম কুমার সম্পর্কে দুটো কথা বলতে এত অনীহা ?’ বলেই ফোনটা রেখে দিলেন। কিছুক্ষণ পর  ফোন করলেন স্বয়ং সুচিত্রা সেন। বললেন, ‘বলুন, কী জানতে চান?’ অমিতবাবুই কাগজ কলম হাতে সুচিত্রার লেখার নোট নিলেন। সেই শুরু। তারপর একদিন ডাক পড়ল মহানায়িকার বাড়িতে। ক্রমশ বাড়ির লোক হয়ে গেলেন। আপনি-টা নিমেশে নেমে এল তুমিতে। টুকরো টুকরো কত অজানা কাহিনী ছড়িয়ে আছে। তখন নিজেকে একেবারেই গুটিয়ে নিয়েছেন সুচিত্রা। কোথাও যান না, কারও সঙ্গে দেখা করেন না। কিন্তু সাত সকাল, মাঝদুপুর, রাত – যখন তখন হানা দিয়েছেন রানিকুঠির এই আবাসনে। কোনও দিন বলতেন, ‘আজ সারাদিন তোমার ঘরে থাকব।’ কোনও দিন রাতে হঠাৎ এসে বলতেন, ‘আজ কিন্তু খেয়ে যাব।’ অমিতবাবুরও ডাক পড়ত মহানায়িকার ঘরে। তিনিও নিজে রান্না করে খাওয়াতেন এই প্রিয় বন্ধুকে। একটা মজার গল্প শুনেছিলাম তাঁর কাছে। সুচিত্রা সেন দুপুরে খেতে আসবেন। অমিতাভ চৌধুরি বলে রাখলেন সাহিত্যিক বন্ধু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে। টেবিলে ছিল কিছু আঙুর। সুচিত্রা ছাড়িয়ে সবার হাতে তুলে দিচ্ছিলেন। বাকিরা আঙুর মুখে পুরলেন। শুধু শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় সেই আঙুরগুলি খেলেন না। বুক পকেটে রাখলেন। সুচিত্রা জানতে চাইলেন, ওগুলো পকেটে রাখলেন কেন ? রসিক শ্যামলের তৎক্ষণাৎ জবাব, ‘সুচিত্রা সেন আঙুর দিলেন। আমি সেটা খেয়ে ফেলব! আমি এতই বেরসিক? সুচিত্রা সেন কিছু দিলে সেটা বুকে রাখতে হয়।’ সুচিত্রাও হেঁসে ফেললেন। এমন কত স্মৃতি উজাড় করে দিতেন প্রবীণ মানুষটা।

idira gandhi

পড়াশোনার সূত্রে কেটেছে শান্তিনিকেতনে। শেষ বয়সের রবি ঠাকুরকেও দেখেছেন। বিশ্বভারতীতে পড়িয়েওছেন। সেখান থেকেই পরিচয় ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। ফলে, ইন্দিরার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতেও সময় লাগেনি। ইন্দিরা শান্তিনিকেতনে এলেই ডাক পড়বে অমিতবাবুর। একসঙ্গে বেশ কিছু বিদেশ সফরেও ছিলেন। একই ছাতার তলায় তিনি আর ইন্দিরা, এমন ছবিও দেখেছি।

বঙ্গবন্ধু মুজিবরও বিশেষ স্নেহ করতেন এই মানুষটিকে। নিজের ধানমন্ডির বাড়িতেও নিয়ে গেছেন। আপ্যায়ন করেছেন। মুখে মুখেই বানিয়ে ফেলেছিলেন ছড়া, ‘‘এপার বাংলা, ওপার বাংলা / মধ্যেখানে চর / তার মাঝেই জেগে আছেন /  শেখ মুজিবর ।।’’ এমন হাজার হাজার ছড়া তৈরি হয়ে যেত মুখে মুখেই।

তাঁর বইয়েই পড়েছিলাম। পরে তাঁর মুখ থেকেও শুনেছিলাম একটি মজার কথা। পেলে কলকাতায় আসবেন। অমিতবাবু তখন যুগান্তরের যুগ্ম সম্পাদক। কীভাবে কভারেজ করা যায় ? কীভাবে আনন্দবাজারকে টেক্কা দেওয়া যায় ? অমিতবাবু দুটি কাজ করলেন। আগেই ভেবে নিলেন, পেলে এলে উঠবেন গ্র্যান্ড হোটেলে। ওই হোটেলে এক রিপোর্টারের নামে আগাম দুদিনের রুম বুক করে দিলেন। খোঁজ নিলেন পেলে আসবেন সিঙ্গাপুর হয়ে।  কাউকে কিছু না জানিয়ে এক রিপোর্টারকে পাঠিয়ে দিলেন সিঙ্গাপুর। যে বিমানে পেলে আসবেন, সেই বিমানের টিকিট কেটে সেই সাংবাদিকও  এলেন পেলের সঙ্গে, একই বিমানে। পেলে কলকাতায় আসার আগেই দু গোল দিলেন। আর দ্বিতীয়ার্ধের গোলটা দিলেন গ্র্যান্ড হোটেলে। ভাবতে পারেন, সাতের দশকে এমন অভিনব ভাবনা ভেবেছিলেন এই মানুষটা।

রবিবার মানেই তাঁর বাড়িতে জমজমাট আড্ডা। কে আসতেন না সেই আড্ডায় ! হেমন্ত মুখার্জি থেকে সলিল চৌধুরি, বসন্ত চৌধুরি থেকে দেবব্রত বিশ্বাস, প্রণব মুখার্জি থেকে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুচিত্রা মিত্র থেকে প্রেমেন্দ্র মিত্র। তালিকাটা বোধ হয় বলে শেষ করা যাবে না। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কথা উঠলেই বেরিয়ে আসত অপত্য একটা স্নেহ, ‘ছোটবেলা থেকে দেখেছি তো। ওর যে কত পড়াশোনা, কেউ জানলই না। গীতবিতানের যে কোনও একটা বইয়ের পাতা খুলুন। সেখান থেকে একটা না একটা গান ও পুরোটা বলে দিতে পারে। ওকে কেউ বুঝলই না। আমি ওকে বলেছিলাম, তোমার জন্য তথ্য সংস্কৃতি ঠিক আছে। পুলিশমন্ত্রী তোমার জন্য নয়। ও শুনত, আর মুচকি মুচকি হাসত। ওর সম্পর্কে যখন কেউ খারাপ কিছু বলে, কষ্ট হয়। আসলে, ও তো নিজেকে আড়ালেই রেখেছিল। ওর ভাল দিকগুলো কখনও জাহির করেনি। এটা জাহির করার যুগ, সেটা বুঝলই না।’

হাত কাঁপত। তার মাঝেই একটা করে সিগারেট ধরাতেন। বলতেন, ‘জানি, এটা খেতে নেই। কিন্তু এতদিনের অভ্যেস, ছাড়তেও পারি না।’ পুরানো দিনের কথা শুনতে খুব ইচ্ছে করত। আবার মনে হত, এই বয়সে মানুষটার উপর হয়ত একটু বেশি অত্যাচার হয়ে যাচ্ছে। খেই হারিয়ে যেত। কিন্তু যে শাখাপ্রশাখায় চলে যেতেন, তা যে আরও সুন্দর। এমন কত ডালপালা ছড়িয়েছিল মানুষটার। সেই ছায়ার নিচে বেড়ে উঠেছেন আরও কত কিংবদন্তি। আধুনিক বাংলা সাংবাদিকতার জনক চলে গেলেন। আমরা কী অদ্ভুত নীরবতা পালন করলাম!

বাঙালি, তুমি সত্যিই ইতিহাস-বিস্মৃত জাতি। হ্যাঁ, তুমি আত্মঘাতীও।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.