স্বরূপ গোস্বামী
সকাল থেকেই শুনে আসছি, পার্ক স্ট্রিট ধর্ষণ কান্ডে নিগৃহীতার মৃত্যু। একের পর এক চ্যানেল সার্ফিং করে গেলাম। সব জায়গায় সেই একই লাইন। সেই একই ক্যাপশান। যেন সেটাই তাঁর একমাত্র পরিচয়। প্রতিনিয়ত আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি, দেখো, ওই মেয়েটাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। ধর্ষণকারী আসলে কে ? ওই বখাটে ছেলেগুলো ? নাকি আমাদের সমাজ ? নিগ্রহ আসলে কে করেছে ? গভীর রাতের সেই ছেলেগুলো ? নাকি তামাম মিডিয়া ?
কই, তিনি তো নিজের নাম গোপন রাখতে চাননি। তিনি বারবার বলে এসেছেন, আমি লুকিয়ে থাকব কেন ? আমি তো কোনও অন্যায় করিনি । আমার নাম স্বচ্ছন্দে লিখতে পারেন। আমার নাম সুজেট। তাঁর সেই বলিষ্ঠ প্রতিবাদ আমাদের কারও মনেই দাগ কাটল না! এরপরেও আমরা তাঁকে শুধু নিগৃহীতা বলেই চিহ্নিত করে যাব ? যিনি এভাবে প্রতিবাদে গর্জে উঠলেন, যিনি সব জড়তা-সংকোচ ভেঙে সামনে এগিয়ে এলেন, তাঁকে নির্যাতিতা বলে চিহ্নিত করাটা কি খুব জরুরি ? নির্যাতিতা না বলে তাঁকে প্রতিবাদী বলা যায় না ?
মিডিয়া সাধারণত একটা নিয়ম মেনে চলে। কোনও ধর্ষিতা মহিলার ছবি সামনে আনা হয় না। পাছে তাঁকে চিনে ফেলে আবার তাঁর উপর আক্রমণ হয়! অন্যরা তাঁকে চিনে ফেললে মেয়েটির জীবনে আরও নানা বিড়ম্বনা আসতে পারে। এসব ভেবেই প্রেস কাউন্সিলের একটা কোড অফ কন্ডাক্ট অনেকেই মেনে চলে। পার্ক স্ট্রিটে সেই বিতর্কের পর সেই মেয়েটিও নিজেকে শুরুর দিকে আড়ালেই রেখেছিলেন। সাক্ষাৎকার নেওয়া হলেও তাঁর মুখ দেখানো হয়নি। কিন্তু পরের দিকে সেই মেয়েটি আর নিজেকে আড়ালে রাখেননি। নারীদের বিরুদ্ধে নির্যাতন হলেই রুখে দাঁড়িয়েছেন। রাস্তায় নেমে মিছিল করেছেন। সব জড়তার প্রাচীর ভেঙে বলেছিলেন, ‘আমি তো কোনও অন্যায় করিনি। আমি প্রতিবাদ করছি। তাহলে আমি লজ্জায় লুকিয়ে থাকব কেন ? আমি নিজের নাম গোপন রাখব কেন ? আমার নাম সুজেট। লিখতে পারেন। আমার কোনও আপত্তি নেই।’
আমরা কী পরিচয়ে মনে রাখব ওই মেয়েটিকে ? সেই মেয়েটি, যাঁকে দু-একটা লম্পট পার্ক স্ট্রিটে ধর্ষণ করতে চেয়েছিল ? নাকি সেই মেয়েটি, যিনি লজ্জায় লুকিয়ে না থেকে প্রতিবাদে গর্জে উঠেছিলেন ? মৃত্যুর পর সেই প্রশ্নটাই তুলে দিয়ে গেলেন সুজেট।
আর আমরা ! গণমাধ্যমে বিবৃতি দেওয়া ‘বুদ্ধিজীবী’রা ! সমানে বলে চলেছি, ‘পার্ক স্ট্রিট কান্ডে নির্যাতিতা।’ শুধু ‘নির্যাতিতা’কেই মনে রাখব ? সেই প্রতিবাদী মুখটাকে মনে রাখব না ?