পাণ্ডব গোয়েন্দার অজানা কাহিনী

সংহিতা বারুই

কারও বয়স যদি ৭৬ বছর হয়, তবে বলা যেতেই পারে, তিনি বৃদ্ধ হলেন।
কিন্তু তাঁর সম্পর্কে এমনটা বলা যাবে না। তাঁকে বৃদ্ধ বলার আগে অন্তত দশবার ভাবতে হবে। কারণ, আমরা, যারা তারুণ্যের বড়াই করি, তাদের থেকে তিনি অনেক বেশি পরিশ্রমী।
বলা যেতেই পারত, বনস্পতির ছায়া দিলেন সারাজীবন।
কিন্তু তিনি নিজেকে বনস্পতি মনেই করেন না। ছায়া নয়, এখনও রোদে রোদেই ঘোরেন। একা একাই ট্রামে চড়েন, বাসে চড়েন, ঘুরে বেড়ান শহরের অলি গলি পাকস্থলি। ঘোরার গন্ডিটা এখানেই এষ নয়। দেশের নানাপ্রান্তে একা একাই বেরিয়ে পড়েন।
আসলে, এই ৭৬ এও তিনি ছোটদের বন্ধু। ছোটদের মনের কথা আগে যেমন বুঝতেন, এখনও তেমনই বোঝেন। ছোট ছোট ছেলেদের সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। তারা কী পড়াশোনা করছে, কী ভাবছে, কী ভাষায় কথা বলছে, বোঝার চেষ্টা করেন।

pandab goyenda4
আমাদের অনেকেরই ছোটবেলা কেটেছে তাঁর বই পড়ে। বয়স বাড়লেও নেই নেশা থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। এখনও পাড়ায় কুকুর দেখলে মনে পড়ে যায় পঞ্চুর কথা। বাবলু, ভোম্বল, বিলু, বাচ্চু, বিচ্চুরা আমাদের খুব একটা অচেআ নয়। আমি পড়েছি। আমার বাবার ছোটবেলাটাও তাঁর লেখা পড়েই কেটেছে।
প্রিয় পাঠক, আর কোনও ক্লু না দিলেও চলবে। তিনি পাণ্ডব গোয়েন্দার স্রষ্টা ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়। তিনটে প্রজন্মের ছোট বেলার বন্ধু। নিজের অজান্তেই তাঁর চরিত্রগুলোর সঙ্গে কখন যে মিশে গেছি! কেউ কেউ বাড়িতে কুকুরের নাম রেখেছি পঞ্চু। বাংলায় পঞ্চু নামের কুকুরের সংখ্যা কত ? আদমসুমারি, বাঘসুমারি, গন্ডার সুমারির কথা শুনেছি। কুকুর-সুমারি হয় কিনা, জানি না। হলেও কার নাম কী, এমন তথ্য আছে কিনা তাও জানি না। তবে নানা সময় মিলিয়ে পঞ্চু নামে কুকুরের সংখ্যা নিশ্চিতভাবেই হাজার ছাড়িয়ে যাবে।
অথচ, পাণ্ডব গোয়েন্দা হয়ত লেখাই হত না, যদি পঞ্চু না থাকত। না, পঞ্চু কোনও কাল্পনিক চরিত্র নয়। লেখকের অতি আপনজন। তাঁর দেশের বাড়িতে এই নামে একটা কুকুর ছিল। তিনি দেশের বাড়িতে গেলে পায়ে পায়েই ঘুরত পঞ্চু। কোনও এক আত্মীয় ঢিল মেরেছিলেন পঞ্চুকে। সেই থেকেই একটা চোখে দেখতে পেত না পঞ্চু। ষষ্ঠীপদ ফিরে আসবেন হাওড়ার বাড়িতে। কিছু পিছু আসছে পঞ্চু। কিছুতেই পেছন ছাড়ছে না। ট্রেনেও উঠে পড়ল। তাকে নিয়েই তরুণ ষষ্ঠীপদ পৌঁছে গেলেন হাওড়া স্টেশন। স্টেশন থেকে বেরোতেই অন্য কুকুররা ঘিরে ধরল পঞ্চুকে। তাদের হাত থেকে বাঁচাতে তখন পঞ্চুকে কোলে নিয়ে রিক্সায় উঠলেন। নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। সেই থেকে পঞ্চুও পরিবারেরই একজন। মাঝে মাঝেই যেতেন দাশনগরে, সঙ্গী সেই পঞ্চু। কখনও মার্টিল রেল, কখনও আমতা, কখনও বোটানিক্যাল গার্ডেন। লেখকের সঙ্গে সঙ্গে দিব্যি ঘুরে বেড়াল পঞ্চুও।

pandab goyenda2
ষষ্ঠীবাবুর বয়স তখন কুড়ি। তার আগে থেকেই লেখালেখি করতেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। তখন শুকতারার সম্পাদক ছিলেন ক্ষীরোদচন্দ্র মজুমদার। একদিন বললেন, ‘রোজ তোমার পঞ্চুর অনেক গল্প শুনি। তাকে হিরো করে একটা গোয়েন্দা গল্প লেখো।’ কিন্তু শুধু পঞ্চুকে নিয়ে তো গল্প দাঁড়াবে না। এসে গেল বাবলু, ভোম্বল, বিলু, বাচ্চু, বিচ্চু। এরাও কাল্পনিক চরিত্র নয়। যাদের সঙ্গে খেলাধূলা করতেন, মিশতেন, তাদের জীবন থেকেই নেওয়া চরিত্রগুলো। নামগুলো একবার লক্ষ্য করুন। সব নাম ‘বি’ দিয়ে শুরু। বাংলায় বললে ব আর ভ। বাচ্চু আর বিচ্চু কিন্তু মহিলা। ভেবে দেখুন ছয়ের দশকে দুই মহিলা গোয়েন্দা! তারা যাচ্ছে অ্যাডভেঞ্চারে। সমকালের থেকে ভাবনা কতটা এগিয়ে ছিল।
সেই শুরু। একের পর এক সিরিজ চলতেই লাগল। বাঙালির পুজোর অনিবার্য সঙ্গী হয়ে উঠল ‘পাণ্ডব গোয়েন্দা’। কেটে গেল অর্ধ শতাব্দী। কুকুর দেখলেই তাদের নাম রাখা হল পঞ্চু। এখন যখন রাস্তায় যেতে যেতে দেখেন কোনও কুকুরের নাম পঞ্চু, কী মনে হয় ? বেশ তৃপ্তির হাসি দেখা গেল লেখকের মুখে, ‘তখন সত্যিই খুব আনন্দ হয়। এই ছোট ছোট স্বীকৃতিগুলোই তো একজন লেখকের সম্বল। এই ছোট ছোট অনুভূতিগুলো মনকে ছুঁয়ে যায়।’
নিছক গোয়েন্দা গল্প নয়, পাণ্ডব গোয়েন্দা একসঙ্গে আরও অনেককিছু। বন্ধুত্ব, পারস্পরিক বিশ্বাসের গল্প। একসঙ্গে দল বেঁধে বেরিয়ে পড়ার গল্প। নতুন নতুন জায়গায় গিয়ে নতুন রহস্যের সমাধান। পড়তে পড়তে সেই জায়গাটাও ঘোরা হয়ে যেত। এভাবেই কত অজানার কথা জেনে নিয়েছি নিজেদের অজান্তে।

লেখক নিজেও বেড়াতে খুব ভালবাসেন। এই বয়সেও বছরে অন্তত তিন-চার বার লম্বা ট্যুরে ঠিক বেরিয়ে পড়বেন। একসময় ঠাকুমা থাকতেন হরিদ্বারে। তাঁকে দেখতে মাঝে মাঝেই চলে যেতেন। সেই অভ্যেসটা এখনও ছাড়তে পারেননি। বছরে একবার না একবার তাঁকে হরিদ্বার যেতেই হবে। প্রায় পনেরো-কুড়ি দিন থেকে আসেন। কোনও সঙ্গীর পরোয়া করেন না। একা একাই বেরিয়ে পড়েন। নিজের মনেই এখান ওখান ঘুরে বেড়ান। সেই মনোরম পরিবেশে আস্ত উপন্যাসও লিখে ফেলেন। জীবনে অনেক লেখা বেড়াতে গিয়েই লিখে ফেলেছেন।
পাণ্ডব গোয়েন্দার পাশাপাশি লিখে গেছেন ভূতের গল্প। লিখেছেন অজস্র ভ্রমণ কাহিনী। ইদানীং ভূতের গল্প বিশেষ লিখছেন না। তবে ভ্রমণ কাহিনী লেখার জন্য দেশের নানাপ্রান্তে চষে বেড়ান। নতুন নতুন জায়গা, নতুন নতুন মানুষ খুঁজে বেড়ানো। এই বয়সেও শখ বা নেশা বলতে এই বেড়ানোই।

pandab goyenda3
বাড়িতে স্ত্রী। তিন মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। নিজেই থলি নিয়ে বেরিয়ে পড়েন বাজার করতে। গাছপালা ভালবাসেন। পশুপাখিদের প্রতি টান এই ছোটবেলা থেকে। টিভি দেখেন না বললেই চলে। রাজনীতিতে কোনও আগ্রহ নেই। ঘরে থাকলে সারাদিন লেখালেখি নিয়েই কেটে যায়। নতুন নতুন ভাবনা ঘুরপাক খেতে থাকে। কখনও বেড়িয়ে আসার গল্প লিখতে বসেন। আবার কখনও অনেক তথ্য জোগাড় করে রাখেন, বেড়াতে গিয়ে সেগুলো লিখে ফেলেন।

মাঝে শোনা গিয়েছিল, পাণ্ডব গোয়েন্দা নিয়ে নাকি সিনেমা হবে। পরিচালক মৈনাক ভৌমিক আর প্রযোজক রানা সরকার লেখকের বাড়িতেও এসেছিলেন। চুক্তি হয়েছিল, প্রাথমিকভাবে অভিনেতা বাছাইও হয়েছিল। নানা কারণে, সেই কাজ আটকে আছে। লেখকের দাবি ছিল, ছবির প্রয়োজনে গল্পে টুকটাক পরিবর্তন করা যেতেই পারে। কিন্তু তা গল্পের মূলস্রোত থেকে যেন কখনও সরে না যায়। মেনে নিয়েছিলেন পরিচালক। বলেছিলেন, ‘গল্পের কোনও নড়চড় হবে না।’ সময়ের দাবিতে বাবলুরা যদি মোবাইল ব্যবহার করে, আপত্তি নেই লেখকের। কিন্তু তাদের বয়স যেন উনিশ, কুড়ির মধ্যে হয়, এমনটাও জানিয়ে দিয়েছেন। তবে সিনেমা নিয়ে তাঁর খুব একটা আগ্রহ আছে বলে মনে হল না। তাঁর কথায়, ‘সিনেমা হলে কিছু লোক দেখবে ঠিকই। তবে যাদের পড়ার অভ্যেস, তাদের সিনেমা দেখে ঠিক তৃপ্তি হবে না। আমি নিজে সিনেমা নিয়ে তেমন আগ্রহী নই। আমার লিখতেই ভাল লাগে। লেখা নিয়েই থাকতে চাই।’
লেখা নিয়েই আছেন। দিব্যি আছেন। সংসারী হয়েও সন্ন্যাসীর মতো। প্রবীণ হয়েও নবীনের মতো।

amazon-giftsoflove

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.