গামছা পরে ঢুকে পড়েছিলেন বিধানসভায়

স্বরূপ গোস্বামী

কিছু হলেই সবাই চলে যাচ্ছে সবজান্তা গুগলের কাছে। যেন সেখানে হাতড়ালেই সব পাওয়া যাবে। বাঙালির বড় একটা দুর্নাম, বাঙালি ডাউনলোড করে, কিন্তু সে আপলোড করে না। তাই বেচারা গুগল মাঝপথে গিয়েই থমকে যায়।
গুগলে খোঁজ করুন, সুনীতি চট্টরাজ কে ?‌ দু এক লাইন ধোঁয়াশা ভরা উত্তর। ছবি সার্চ করলে বেরিয়ে আসবে ভাষাতত্ববিদ সুনীতি চট্টোপাধ্যয়ের ছবি। ভাগ্যিস, ওই ছবি কোনও কাগজে ছাপা হয়নি। হলে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। এমন একজন বর্ণময় চরিত্র চলে গেলেন। অথচ, কাগজ পড়লে বোঝার উপায় নেই। কলকাতার অধিকাংশ প্রথমসারির কাগজে খবরটা জায়গাই পায়নি। অন্তত কলকাতা এডিশনে নেই। নেটের সুবাদে বীরভূম এডিশনে গিয়ে দেখলাম, নাম কে ওয়াস্তে ছোট্ট একটা কপি। তাতে প্রায় কিছুই নেই। যে তথ্য আছে, তাও বোধ হয় গুগল থেকে পাওয়া।
বর্তমান সাংবাদিকতার সবথেকে বড় সংকট বোধ হয় এখানেই। যাঁরা সাংবাদিকতায় আছেন, তাঁদের অনেকের লেখা পড়লেই বোঝা যায়, দু হাজার সালের আগে তাঁরা কাগজটাও পড়তেন না। বড় বড় টিভি সঞ্চালকেরও সেই দশা। বিরাট সবজান্তা ভাব। কিন্তু নয়ের দশক বা আটের দশকের প্রসঙ্গ উঠলেই বোকা বোকা সরলীকরণ। পরিষ্কার বোঝা যায়, সেই সময় তাঁরা কাগজটা পড়তেন না।তাই সেই সময়ের ঘটনাপ্রবাহ সম্পর্কে কোনও ধারনাই নেই। হয়ত সেই কারণেই সুনীতি চট্টরাজ সম্পর্কে এমন উদাসীন থাকতে পারেন।

সুনীতি চট্টরাজ বলতেই একটা ছবি ফুটে ওঠে। সেটা হল বিধানসভায় গামছা পরে ঢুকে যাওয়া। হ্যাঁ, কুড়ি বছর আগে একবার এমন কাণ্ডই ঘটিয়েছিলেন সিউড়ির ‘‌সোনাদা’‌। সম্ভবত জুলাই মাস। দীর্ঘদিন পর আবার বিধানসভায় ফিরে এসেছিলেন বর্ণময় সুনীতিবাবু। বাড়ি থেকে এসেছিলেন সাফারি শুট পরে। সভায় ঢোকার আগে পোশাক বদলে ফেললেন। জামা–‌প্যান্ট খুলে ফেললেন। একটি তোয়ালে আর স্যান্ডো গেঞ্জি। এই পরেই তিনি বিধানসভায় গটগট করে ঢুকে পড়লেন। সবাই হতবাক। হওয়ারই কথা। কারণ, বিধানসভার দীর্ঘ ইতিহাসে এই পোশাক পরে কেউ কখনও বিধানসভায় এসেছেন বলে জানা নেই। সারা দেশেও সম্ভবত এমন নজির নেই ?‌

suniti-chattaraj

কেন এমন পোশাকে এসেছিলেন সুনীতিবাবু ?‌ তাঁর যুক্তিটি ছিল অভিনব। তিনি বলেছিলেন, ‘‌আমার এলাকা জলমগ্ন। রাস্তায় কাদা জমে আছে। সরকার উদাসীন। আমার এলাকার অনেক মানুষ বাধ্য হয়ে গামছা পরেই যাতায়াত করছেন। আমি তাঁদের প্রতিনিধি। তাই আমি গামছা পরে এই বিধানসভায় প্রতিবাদ জানিয়ে গেলাম।’‌
এমন প্রতিবাদের সঙ্গে আপনি একমত না হতে পারেন। কিন্তু পন্থাটা যে অভিনব, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। এবং এ ব্যাপারে তিনি যে কাউকে অনুকরণ করেছিলেন, এমনটাও বলা যাবে না। কারণ, তাঁর আগে কেউ এমন কাণ্ড করেননি। সেই সময়ে বিষয়টি নিয়ে ঝড় উঠেছিল। তখন সন্ধে হলে টিভি চ্যানেলে বুদ্ধিজীবী গিজগিজ করত না। নইলে, এই নিয়ে বেশ কয়েকটা ‘‌ঘণ্টাখানেক সঙ্গে সুমন’‌ গোছের অনুষ্ঠান হয়ে যেত। সোশাল সাইটে সেই ছবি হাজার হাজার শেয়ার হয়ে ভাইরাল হয়ে যেত।
খুব ভাল বক্তা ছিলেন, এমন নয়। কিন্তু তিনি বিধানসভায় আসা মানেই বিধানসভা যেন আরও বর্ণময় হয়ে উঠত। জ্যোতিবাবু বক্তৃতার সময় বিশেষভাবে দু–‌একজনের উল্লেখ করতেন। একজন যদি সত্য বাপুলি হন, তবে আরেকজন অবশ্যই সুনীতি চট্টরাজ। দুজনের নাম নিয়ে প্রায়ই কটাক্ষ করতেন, ‘‌বাবা–‌মা অনেক আশা নিয়ে ছেলেদের নাম রাখে। এখানে একজন আছেন, নাম সত্য, কিন্তু কখনও সত্য কথা বলেন না। আরেকজন সুনীতিবাবু। নাম সুনীতি, কিন্তু কোনও নীতিই নেই।’‌ আপাত গম্ভীর জ্যোতিবাবু যখন এমন খোঁচা দিতেন, বিধানসভায় উঠত হাসির ফোয়ারা। এমনকি বিরোধীরাও মুখ টিপে টিপে হাসতেন। সুনীতিবাবু নিজেও মজা পেতেন, দিব্যি উপভোগ করতেন। তিনিও পাল্টা রসিকতা ছুঁড়ে দিতেন, আপনার নাম তো জ্যোতি, তাহলে রাজ্যে এত লোডশেডিং কেন?‌ জ্যোতিবাবুও হেসে ফেলতেন। বিধানসভার প্রসিডিংসে এইসব টিকাটিপ্পনি নথিবদ্ধ আছে। কে আর উল্টে দেখে!‌ আসলে, তখন পরিবেশটাই অন্যরকম ছিল। বিরোধীতার বুদ্ধিদীপ্ত একটা পরিসর ছিল। কথায় কথায় স্পিকারকে ডানদিকে তাকাতে হত না। কেউ সামান্য সমালোচনা করলে তা এক্সপাঞ্জ হত না। সময়টাই বদলে গেছে। হারিয়ে গেছে সেই রসবোধ। তাই বর্ণময় সুনীতিবাবুরা নিঃশব্দে বিদায় নেন। কেউ জানতেও পারে না।

flipkart-tvdays

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.