কোহলি বোঝালেন, গ্রেটরা মঞ্চ বেছে নিতে ভুল করে না

অজয় নন্দী

জাঁহাপনা, তুসি গ্রেট হো। ভরা ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে এভাবেই যেন শ্রদ্ধা জানিয়েছিলেন শচীন তেন্ডুলকারকে। একদিনের ক্রিকেটে শচীনের সর্বাধিক শতরানের রেকর্ড টপকে গিয়েছিলেন স্বয়ং শচীনেরই ঘরের মাঠে। নতমস্তকে সেলাম ঠুকে এভাবেই জানিয়েছিলেন অভিবাদন।

গতবছর টি২০ বিশ্বকাপ। তাঁর খেলার কথাই ছিল না। কারণ, বহুদিন দেশের জার্সি গায়ে টি২০ খেলেননি। কিন্তু ইচ্ছে হল, খেলবেন। খেললেন। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর ঘোষণা করে দিলেন, আর নয়। সবাইকে অবাক করে ‘‌গুডবাই’‌ করে দিলেন।

এবারের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। একেবারেই রানের মধ্যে ছিলেন না। কিন্তু মোক্ষম দুটি ম্যাচে জ্বলে উঠল তাঁর ব্যাট। সবথেকে হাই ভোল্টেজ ম্যাচ ভারত–‌পাকিস্তান। সেই ম্যাচে করলেন ম্যাচ জেতানো শতরান। সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া। একদিনের বিশ্বকাপে ফাইনালে এই অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেই হয়েছিল স্বপ্নভঙ্গ। এবার সেই বাধা ভারত দিব্যি উতরে গেল সেই বিরাট কোহলির ব্যাটেই। আসল দুটো ম্যাচেই তিনি জ্বলে উঠলেন। বাকি ম্যাচগুলোয় কী করলেন, কী যায় আসে!‌

এক দশকেরও বেশি সময় ধরে শোনা যাচ্ছিল, শচীনের রেকর্ড যদি কেউ ভাঙতে পারেন, তাহলে একমাত্র বিরাট কোহলি। আরও কারও পক্ষে ওই হিমালয়কে স্পর্শ করা সম্ভব নয়। টেস্টে শচীনের শতরান থেকে তিনি অনেক দূরে। কিন্তু একদিনের ক্রিকেটে শচীনকে অতিক্রম করে গিয়েছেন। বিরাটকে কি কেউ অতিক্রম করবেন?‌ এমন সম্ভাবনা চোখে দূরবিন লাগিয়ে দেখা যাচ্ছে না।

একবার পরিসংখ্যানে চোখ বোলানো যাক। বিরাটের শতরান ৫১। শচীনের ৪৯। অনেকটা পিছিয়ে রোহিত শর্মা (‌৩২)‌। এরপর যে পনেরো জন আছেন, তাঁরা বহুকাল আগেই অবসরের গ্রহে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাঁদের কেউ কোচিংয়ে, কেউ ধারাভাষ্যে। অনেক পিছিয়ে বাবর আজম (‌১৯)‌। এ জন্মে আর তাঁর পঞ্চাশ শতরান হল না। অর্থাৎ, একদিনের ক্রিকেটে কোহলি যে মাইলস্টোনে পৌঁছে গেছেন, আগামী দশ–‌পনেরো বছরে তা অক্ষতই থাকবে। হয়তো সারাজীবনই অক্ষত থাকবে।

এরপরেও বিরাট কোহলিকে পছন্দ করেন না, এমন লোকের সংখ্যা কম নয়। তিনি উদ্ধত। নিজেকে নিয়মের ঊর্ধ্বে ভাবেন। তিনি আগের ফর্মে নেই। তিনি নিজের জন্য খেলেন। তিনি সিনিয়র বা প্রাক্তনদের সম্মান দিতে জানেন না। তিনি ছবিপ্রবণ। তিনি নাটুকেপনা করেন। এমন কত অভিযোগ তাঁর নামে। অভিযোগগুলো উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। কিন্তু তারপরেও তিনি বিরাট কোহলি। শচীনোত্তর ভারতীয় ক্রিকেটের সেরা ব্র‌্যান্ড অ্যাম্বাসাডর।

তিনি কখন কোথায় থাকেন, না জানেন নির্বাচকরা। মাঝে মাঝেই চলে যান স্বেচ্ছা নির্বাসনে। কখনও ভেসে ওঠেন সোশ্যাল মিডিয়ায়। তখন জানা যায়, তিনি অমুক দেশে ছুটি কাটাচ্ছেন। তিনি বিরাট কোহলি। আর দশজনের সঙ্গে তাঁর মিল খুঁজতে যাবেন না। তিনি বাঁচেন নিজের শর্তে। তাঁর ইচ্ছে হলে, তিনি খেলবেন। তাঁর ইচ্ছে না হলে, তিনি খেলবেন না। তাঁর কি চোট?‌ তিনি কি ছুটি কাটাতে বাইরে কোথাও গেছেন?‌ তিনি কি ফের বাবা হতে চলেছেন?‌ বারবার এমন জল্পনা উঠেছে। আর তিনি সেই জল্পনাকে দিব্যি জিইয়ে রেখেছিলেন।

বারো বছর তিনি রনজি ট্রফিতে খেলেননি। আপনার মনে হতেই পারে, বিরাট কোহলি মানে কি আইনের ঊর্ধ্বে!‌ অন্য কেউ হলে এতক্ষণ শৃঙ্খলাভঙ্গের দায়ে হয়তো শাস্তি হয়ে যেত। নইলে অলিখিতভাবে ব্রাত্য হয়ে যেতেন। কিন্তু তাঁকে বাদ দেওয়াও যাবে না। যেদিন খেলতে চাইবেন, সসম্মানে দলে নিতে হবে। বলা যায়, তিনি যেটা চাইবেন, নির্বাচকদের সেই ইচ্ছেকেই মেনে নিতে হবে।

কোনও সন্দেহ নেই, শচীন পরবর্তী যুগে স্টারডমের নিরিখে তিনিই এক নম্বরে। রান পান বা না পান, ফোকাস তাঁর দিকে। তিনি অধিনায়ক থাকুন বা না থাকুন, চর্চা সেই তাঁকে ঘিরেই। স্বদেশি হোন বা ভিনদেশি, বর্তমান হোন বা প্রাক্তন, তাঁর গুণগান গেয়ে যেতেই হবে। সে আপনার পছন্দ হোক বা না হোক। একটু বেসুরো গাইলেই ট্রোলবাহিনী আপনার জীবন ঝালাপালা করে দেবে। এই ব্যাপারে বিজেপির আইটি সেল আর বিরাটের ট্রোলবাহিনীর মধ্যে তেমন ফারাক নেই।

আপনার পছন্দ হোক বা না হোক। মেজাজটাই যে আসল রাজা। তিনি বাঁচেন রাজার মতোই। তিনি বাঁচেন নিজের মর্জিতে।
‌‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.