দেখতে দেখতে ৬০ বছর হয়ে গেল পথের পাঁচালীর। বিভূতিভূষণের মৃত্যু! তাও হয়ে গেল ৬৫ বছর।এখন কোথায় আছে, কেমন আছে সেই অপু? যদি বিভূতিবাবুর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়! তেমনই এক সাক্ষাতের কথা লিখলেন শোভন চন্দ।।
সৃষ্টির একটা মজা রয়েছে,সে সৃষ্টি হয় স্রষ্টার হাতে কিন্তু স্রষ্টার অনুপস্থিতিতেও সময়ের সাথে সাথে স্রষ্টার অস্তিস্ত্ব, জনপ্রিয়তাকে স্মরণীয় করে যায়। কোথাও যেন আপন উপস্থিতিতে সে তাঁর স্রষ্টার নীরব উপস্থিতিবুঝিয়ে যায়। এর এক অন্যতম দৃষ্টান্ত হল বিভূতিভূষণের কালজয়ী সৃষ্টি “পথের পাঁচালি”,যা আজও বাংলাসাহিত্য ও বাঙালির মননে এক অনন্য অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। ১লা নভেম্বর বিভূতিভূষণের মৃত্যুর ৬৫ বছর এবং তাঁর সৃষ্টি “পথের পাঁচালি “এর ৬০ বছর পূর্ণ হল। এতকাল পরেও এই অনন্য সৃষ্টিকে কেন্দ্র করে বাঙালির কৌতূহলের অন্ত নেই ।
১৯২৯ খ্রিঃ বিভূতিভূষণ প্রেম প্রকৃতি অরণ্য নিয়ে সৃষ্টি করেন তাঁর অপুর কাহিনি । পরবর্তী সময়ে সত্যজিৎ রায় তাঁর অপুকে সেলুলয়েডে তুলে আনেন। শুধুমাত্র পথের পাঁচালি নয় পরে “অপরাজিত”,”অপুর সংসার “তৈরি করলেন সত্যজিৎ রায়। তারপর বাকিটা ইতিহাস……। এই যাত্রাপথের পর মাঝে কেটে গেছে অনেকটা সময় কোথায় আছে অপু? কেমন আছে অপু? কেমনই বা প্রতিক্রিয়া তাঁর স্রষ্টা বিভূতিভূষণের ?
নিশ্চিন্দিপুরের সেই কাশফুলের ক্ষেতে হঠাৎই দেখা হয়ে যায় অপুর সাথে বিভূতিভূষণের । বিভূতি বাবুর গম্ভীর জিজ্ঞাসা- কেমন আছ অপু? অপু তো রীতিমতো অবাক,খানিকটা আনন্দে আর অনেকটা বিস্ময়ে অপুর উত্তর – এ কী তুমি ! এতদিন কোথায় ছিলে ? আমি তোমাকে অনেক খুঁজেছি , তোমাকে যে অনেক কিছু বলার আছে। তারপর ধীরে ধীরে অপু বলতে শুরু করে জীবনের নানান কথা- তার জীবনের পাঁচালি ।
আবেগতাড়িত হয়ে সে বলতে থাকে, জানো তুমি তোমার কলমে যেন আমার সুখ,দুঃখ, হাসি- কান্না সব গড়ে দিয়েছো তোমার লেখনীতেই যেন শৈশব থেকে আমি পরিণত হয়ে উঠলাম আমি হারালাম অনেক কিছু তবে যা দিয়ে গেলে তা যেন তোমার ওই সাধারণ অপুকে কালের নিরিখে অসাধারণ করে তুলল।
প্রথম প্রথম আমি তো বইয়ের পাতায় বন্দী ছিলাম তখন মাত্র কিছু লোকেই আমার গল্প জানত। তারপর একদিন এক ভদ্রলোক আমাকে বইয়ের পাতা থেকে নিয়ে গেলেন রুপোলী পর্দায়। সে এক মজার গল্প, জানো। সত্যজিৎবাবু তাঁর সিনেমায় অন্যান্য চরিত্র পেয়ে গেছিলেন কিন্তু অপু চরিত্র নিয়ে খানিক চিন্তিতই ছিলেন, তিনি অপু চরিত্রের খোঁজে ৬-৮ বছরের শিশুদের জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেন । তারপর তাদের পরীক্ষা হয় কিন্তু সত্যজিৎ বাবুর মন ভরল না। তিনি মনের মত অপু খুঁজে পেলেন না তারপর একদিন তাঁর স্ত্রী পাড়া থেকে একটি ছেলে ধরে আনেন। আমি ছিলাম সেই ছেলে –সুবীর ব্যানার্জী । যদিও এ নামে আমাকে তেমন কেউ চেনে না। সত্যজিৎ বাবু আমাকে নিয়ে চরিত্রের টানাপোড়নে কি সবই না করলেন নিজের কাহিনির বিন্যাসে আমাকে ভাঙলেন, গড়লেন ।দেখতে দেখতে তোমার অপু যেন বাঙালির ঘরের ছেলে হয়ে উঠল।
জানো, তোমার অপুর গল্প নিউইয়র্ক থেকে শুরু করে বিদেশের নানান জায়গায় দেখানো হল এমনকি আমার গল্প শুনতে দেশের মুখ্যমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী এসেছিল। তারপর কি জানি সব বদলে গেল!জানো ওই সিনেমাটার পর আমি নিশ্চিন্দিপুরের অজ-পাড়া-গাঁ থেকে সোজা বিলেতে পাড়ি দিয়েছিলাম পুরস্কার আনতে,বহু নামীদামী পুরস্কার জিতলাম।তোমার অপু অল্পদিনের মধ্যেই বিখ্যাত হয়ে উঠল, বহু লেখালেখি হল আমাকে নিয়ে, সেদিন টা খুব মনে পড়ছিল। কত লোকজন তোমাকে নানান কথা বলছিল সে কি প্রশংসা ,তোমার কথা খুব মনে পড়ছিল । আরে আমাকে নিয়ে তৈরি সিনেমাটা তো বাংলা প্যারালাল সিনেমা মুভমেন্টের পথিকৃৎ হয়ে দাঁড়ালো। আজও আমাকে নিয়ে গবেষণার অন্ত নেই। কিছুদিন আগেই আমাকে নিয়ে কৌশিক বাবু সিনেমা বানালেন । নামটাও বেশ দিয়েছিলেন “অপুর পাঁচালি” আমার জীবন নিয়ে গল্পটা ছিল তবে কোথায় জানি সবকিছু মিলে যাচ্ছিল ? সত্যি এ যেন আমার জীবনের পাঁচালি।
আজকাল আমার সিনেমার সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। তবু আজও যেন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছি আমি । যখনই তোমাকে সত্যজিৎ বাবুকে নিয়ে কিছু হয় ঘুরে ফিরে ঠিক আমার কথা চলে আসে। আজও মাঝে মাঝে বহু সম্মান পাই আর বার বার মনে পড়ে তোমাকে । জানি এ বন্ধন এ জন্মে আর ছিন্ন হওয়ার নয় । জানি না তুমি আমায় কী দিয়ে গড়লে। অপু কী করে এত সবার কাছের হয়ে উঠল। তবে এটুকু বুঝতে পেরেছি, তোমার অপু কোনদিন হারিয়ে যাবে না।আচ্ছা দুর্গা কেমন আছে? তুমি তো ওকে আমার কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিলে আর প্রসন্ন মাস্টার মশাই…….. , একের পর এক প্রশ্ন উত্তর চলতে থাকে । কথা যেন শেষই হতে চায়না,আর বিভূতিভূষণ নিজ সৃষ্টি সুখের উল্লাসে হাসতে থাকেন।