কমরেড, ভুলেও ফাঁদে পা দেবেন না

‌:সত্রাজিত চ্যাটার্জি

 

বিগতকয়েকদিন রাজ্য তথা দেশীয় রাজনীতি উত্তাল প্রধানমন্ত্রীর “কালো টাকা” উদ্ধারের চেষ্টায় ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোট নিষিদ্ধ করাকে কেন্দ্র করে। কেন্দ্রের শাসক দল ছাড়া ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রধান প্রায় সবকটি দলই এই সিদ্ধান্তের মিশ্র-(প্রধানতঃ বিরূপ) প্রতিক্রিয়া দিয়েছে  । ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিয়ে ব্যাঙ্ক থেকে টাকা তুলতে গিয়ে সাধারণ মানুষের হয়রানিকে উপলক্ষ্য করে সহানুভূতি জানিয়েছে এবং কেন্দ্র তথা প্রধানমন্ত্রীকে এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তথা শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসের নেত্রী কেন্দ্রের শাসক  বিরোধী অন্য দলগুলিকে একজোট করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটতে নেমে পড়েছেন। উদ্দেশ্য একটাই,কেন্দ্রের শাসক দল বিজ়েপি বিরোধী একটা মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত করা।  আর যদি সেই কাজে তিনি সমর্থ হনও, তাহলে বলতে দ্বিধা নেই তিনিই হবেন সেই বিরোধী মঞ্চের ঘোষিত বা অঘোষিত প্রধাননেত্রী। এটাই তার প্রাথমিক উদ্দেশ্য। এবং আশ্চর্যজনক ভাবে তিনি তাঁর দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের প্রধান প্রতিপক্ষ সি.পি.এম কেও পাশে চেয়েছেন ও দলের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরিকে ফোন করে তাঁর সেই প্রস্তাবের কথা জানিয়েছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সীতারামবাবু কী সিদ্ধান্ত নেবেন ? কমিউনিস্ট পার্টিতে এককভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না,এটা সর্বজনবিদিত। এখানে যে কোনও সিদ্ধান্ত– তা গঠনমূলকই হোক আর বিরোধীই হোক,সরকারে থাকা অবস্থাতেই হোক আর বিরোধী অবস্থানেই হোক,পার্টি সর্বোচ্চ নেতৃত্ব বা পলিটব্যুরোই সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পলিটব্যুরোও একক সিদ্ধান্তে নয়-বর্তমানে ১৬ জন সদস্যের সহমতের ভিত্তিতেই  কোনও পদক্ষেপ করা হয়। তবুও পার্টির সাধারণ সম্পাদক পদের ভিত্তিতে এবং দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বহুমুখী অভিজ্ঞতায় সীতারামবাবুর মতের একটি বিশেষ গুরুত্ব আছে বৈকি। তিনি তো আর শুধু পার্টির সাধারণ সম্পাদক নন, তিনি বর্তমানের ভারতবর্ষের বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ। সুদূর গ্রীসের রাজধানী এথেন্সে গিয়েও তিনি বক্তব্য রেখে এসেছিলেন। সুতরাং তাঁর মত একটি বিশেষ গুরুত্ব পাবে, এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না।

sitaram2

তাই সীতারামবাবু কী মত দেবেন ? রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা  জানেন, বর্তমানে  কেন্দ্রের শাসকদল তথা বিজেপি ই বামপন্থীদের সবসময়ের  প্রধান  প্রতিপক্ষ। একটি উগ্র হিন্দুত্ববাদী, দক্ষিণপন্থী দল যারা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ইন্ধন যোগায় তাদের বিরুদ্ধে বামপন্থীরা বরাবর লড়ছে। বর্তমানে ক্ষমতার নিরিখে বামপন্থীরা সংসদে ক্ষয়িষ্ণু । তাই প্রধানমন্ত্রীর এই হঠকারী সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে  বিজেপি বিরোধিতার এমন সুবর্ণ সুযোগের সদব্যবহার করতে সি.পি.এম তথা বামপন্থীরা কি বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রীর ডাকা  সর্বদলীয় বৈঠকে যাবেন নিজেদের জাতীয় রাজনীতিতে শক্তিশালী করতে ? এই নিয়ে জল্পনা বিভিন্ন মহলে।

কিন্তু কথাটা হল সীতারামবাবুরা কেন যাবেন ? কেন সাড়া দেবেন এমন একজনের ডাকে যার কোন রাজনৈতিক নীতিবোধ ও বিশ্বাসযোগ্যতাই নেই। ক্ষমতার অলিন্দে থাকতে যিনি অষ্টপ্রহর নিজের রঙ বদলাতে জানেন। যিনি অতীতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে বাম শক্তিতে হঠাতে কখনও কংগ্রেস কখনও বা সেই বিজেপিরই সাথে জোটে গিয়েছিলেন। গুজরাটের ভয়াবহ  সাম্প্রদায়িক  দাঙ্গার পরে তদানীন্তন গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী তথা অধুনা ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী যখন দেশে ও বিদেশে প্রবলভাবে ধিক্কৃত ও সমালোচিত হয়েছিলেন ,তখন দ্বিতীয়বারের জন্য তিনি গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী পদে নির্বাচিত হওয়ার পরে তাকে বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী তথা তদানীন্তন বাংলার বিরোধী নেত্রী ফুলের তোড়া পাঠিয়ে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছিলেন।আর আজ তিনি ক্ষমতার লোভে,জাতীয় রাজনীতিতে নিজেকে ও তার দল  তৃণমূল কংগ্রেস কে প্রাসঙ্গিক করতে বামপন্থীদের সাহায্য চাইছেন কেন্দ্রের শাসক দলের বিরোধিতা করতে !!!  আর সেখানে এটাও চাইছেন বামেরা তার আহ্বানে সাড়া দিয়ে পরোক্ষে তাঁরই বশ্যতা স্বীকার করুক। যে বামশক্তিকে বাংলা থেকে নির্মূল করতে তিনি অতীতে কংগ্রেস,বিজ়েপি,SUCIএমন কি অঘোষিতভাবে কামতাপুরী বা জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের সাথে পর্যন্ত হাত মিলিয়েছিলেন!! তাঁর আহ্বানে বামপন্থীরা সাড়া দেবেন কেন ? বামপন্থা এত ঠুনকো নাকি? বামপন্থীরা তাঁর মতো ক্ষমতালোভী নাকি ? বিগত বিধানসভা নির্বাচনে যিনি প্রায় দুই তৃতীয়াংশ আসনে জিতে দ্বিতীয়বারের জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে প্রধান কর্মসূচি নিয়েছেন বামপন্থী ও বিরোধীদের হাতে থাকা পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ ও বিধানসভা একের পর দখল করার। তাঁর দলের বিধায়ক, মন্ত্রী, কাউন্সিলর থেকে সাধারণ নেতাদের তিনি অলিখিত নির্দেশ দিয়েছেন হয় টাকার বিনিময়ে অথবা মিথ্যে মামলায় ফাঁসানোর ভয় দেখিয়ে বা ঘর বাড়ি, চাষের জমি লুঠ করে বা খুন রক্তপাতের ভয় দেখিয়ে বাম দল ও অন্যান্য বিরোধী দলের রাজনৈতিক নেতাদের হাটে গরু ছাগলের মত কিনে নেওয়ার। আর সে কাজে তিনি ও তার সুযোগ্য ভাইয়েরা যে কতটা সফল তা তো প্রতিদিন খবরের কাগজ পড়লেই স্পষ্ট বোঝা যায়। এমন একটি রাজনৈতিক দলের নেত্রীর আহ্বানে বামপন্থীরা সাড়া দেবেন ? মুখ্যমন্ত্রী ও তার দল সারদা আর্থিক কেলেঙ্কারিতে আকন্ঠ নিমজ্জিত, যে মামলাতে হাজার হাজার প্রতারিত মানুষ সর্বস্বান্ত হয়ে আত্মঘাতী হয়েছে। বহু এজেন্ট সময়মতো টাকা ফেরত দিতে না পেরে আমানতকারীদের চাপে আত্মহত্যা করেছেন। আর সাধারণ মানুষের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে উপার্জিত অর্থ ও সঞ্চয় ভোগ করেছে এই নেত্রী ও তার দলের অর্থলিপ্সু, ক্ষমতালিপ্সু অন্যান্য সদস্যরা।

mamata modi

কমরেড, আপনারা অনেক লড়াই করে এই দুর্নীতির বিচার চেয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেছিলন এবং সেই মামলাটি যাতে সুপ্রিম কোর্টে না ওঠে তার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও তার সুযোগ্য “শুভাকাঙ্খী”রা সর্বোতোভাবে চেষ্টা করেছিল। সরকারি টাকায় তদন্তের বিরোধীতা করে মামলা করেছিল। তারপরেও সুপ্রিম কোর্ট যখন সেই মামলার তদন্তভার কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা শাখা সি.বি.আই এর ওপর অর্পণ করে,দেশের মহামান্য সর্বোচ্চ আদালতের সেই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে মুখ্যমন্ত্রীর দলের নেতা ও কর্মীরা সি.বি.আই এর অফিস ঘেরাও করেছিল।মুখ্যমন্ত্রী একজন মহিলা হয়ে দলীয় সভায় অশ্রাব্য ভাষায় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছিলেন। রাজ্যের ক্রীড়া ও পরিবহন মন্ত্রী মদন মিত্র কে সি.বি.আই সারদা কেলেঙ্কারিতে গ্রেফতার করার পরে খোদ মুখ্যমন্ত্রী তার দলীয় সদস্য ও সমর্থকদের সাথে নিয়ে “আমরা সবাই চোর” লেখা প্ল্যাকার্ড হাতে রাস্তায় নেমেছিলেন সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে। সঙ্গেকিছু স্বার্থান্বেষী অতীত ও বর্তমানের ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ও শিল্পীকূল !!!  এর থেকে লজ্জার কিছু আছে ? কমরেড, এতো দূর অতীতের ঘটনা নয়। আপনারা ভুলে গেলেন এইসব কাহিনী ?  এত বড় আর্থিক কেলেঙ্কাতিতে তিনি ও তার দল যুক্ত। সেই কেলেঙ্কারিতে প্রতারিত, সর্বস্বান্ত, বুভুক্ষু মানুষের হাহাকার,অশ্রুপাত  যার কাছে ছিল বিরোধী দলের  “রাজনৈতিক চক্রান্ত”  সেই  তিনি আজ কেন্দ্রের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে  সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ ও হয়রানিতে “কুম্ভীরাশ্রু” বর্ষণ করছেন !! প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তোপা দেগে বামপন্থীদের পাশে চাইছেন সুকৌশলে যাতে তাদের কিনে নেওয়া যায়, তার পায়ের তলায় আনা যায়। তাদের ওপর একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করা যায়। সীতারামবাবু আপনি সেই নেত্রীর ফোন ধরে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার আলোচনা করছেন? এর নাম অতীতের সেই স্বজনহারানো, রক্তঝরা গণআন্দোলন ? এর নাম গণ অভ্যুত্থান ? ২১০ জন বামপন্থী কর্মী খুন হয়ে গেছেন ইতিমধ্যে । হাজার হাজার বামকর্মী ঘর বাড়ি ছাড়া। পরিবার-পরিজন, মা, বাবা, ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, পুত্র, কন্যা ছাড়া। মিথ্যে মামলাতে শয়ে শয়ে কর্মী জ়েলের অন্ধকারে  পচছে। সম্প্রতি শারদোৎসব ও দীপাবলি গিয়েছে। সেই আনন্দোজ্জ্বল মুহূর্তেও সেই পার্টি নিবেদিত প্রাণ কমরেডরা এক মুহূর্তের জন্য নিজেদের পবিবার পরিজনের মুখ দেখতে পারেনি। শুধুমাত্র বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ও তার দলের প্রতিহিংসার রাজনীতির বলি হয়ে। এমন একটি ঘৃণ্য দলের সাথে বামপন্থীরা সহাবস্থানে যেতে পারেন ? এও কখনও সম্ভব ?

সীতারামবাবু, এখন সময় এসেছে বলিষ্ট জনমত গড়ে তোলার। সময় এসেছে পার্টিকে আরও সুসংহত ও সুশৃঙ্খলিত করার। আপনি দেশের বামপন্থী আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ। সুদূর গ্রিসের এথেন্সে আপনাকে বক্তৃতা দিতে দেখে একজন বামপন্থী মানুষ হিসেবে আমি গর্বিত হই। আপনি সুবক্তা, উচ্চশিক্ষিত, রুচিশীল, দায়িত্বনিষ্ঠ মানুষ। আপনি কেন ওই পাপের সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দেবেন ?? বছর দুই আগে কেন্দ্রের শাসকদল বিরোধী একটি অবস্থানে তৃণমুল সাংসদদের আহ্বানের উত্তরে বাংলার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা আদর্শনিষ্ঠ বামপন্থী নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বলেছিলেন ,”তৃণমূলের সাথে বামপন্থীরা সহাবস্থানে যাবে ? তৃণমূল উপর থেকে নীচ পর্যন্ত আগাপাশতলা সমাজবিরোধীদের দল। হিংস্র একটি দল । বাংলা ও দেশের সভ্যতা, সংস্কৃতি, মূল্যবোধকে ধ্বংস করছে ওরা। ওদের সাথে বামপন্থীরা কোনওদিন যেতে পারে না। ওদের সাথে রাস্তাতেই দেখা হবে”। একজন  আজন্ম কর্তব্যনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ নেতা তথা বামপন্থী আন্দোলনের কান্ডারীর আদর্শ উক্তি। তাই মানুষের হয়ে কথা বলুন। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে উগ্র হিন্দুত্ববাদী, দক্ষিণপন্থী শক্তির নেতার বিরোধিতা করুন। নিজেদের ক্ষমতালোভী প্রমাণ না করে বরং মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের হয়ে কথা বলে প্রধানমন্ত্রীর এই হঠকারী“তুঘলকি সিদ্ধান্তের” বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ একটি জনমত গড়ে তুলুন। ভুলেও একটি ক্ষমতালোভী, বিকৃতরুচিসম্পন্ন  নেত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ফাঁদে পা দেবেন না। তাতে ভারতবর্ষের  ইতিহাসে বামপন্থীদের স্বর্ণাক্ষরে লিখিত গণআন্দোলনের গৌরবগাথা ম্লান, ম্রিয়মাণ হয়ে যাবে।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.