সত্রাজিত চ্যাটার্জি
লেখাটা শুরু করছি নজরুলের বিখ্যাত একটি গানের প্রথম দুই লাইন দিয়ে ।
“চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়,
আজকে যে রাজাধিরাজ, কাল সে ভিক্ষা চায় ।”
সময় বড় নিষ্ঠুর । সে কারো বাধা মানে না । আজকের ঐশ্বর্যশালী সম্রাটকে সে কালকেই হতদরিদ্র ভিক্ষুকে বদলে দিতে পারে । সময়ের অমোঘ আঘাতে কালজয়ী বীররাও তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য হারিয়ে একদিন কারারুদ্ধ হয়ে ভগ্নশরীরে, ভারাক্রান্ত হৃদয়ে পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে । ইতিহাসের পাতায় এর অজস্র উদাহরণ আছে ।
আবার কোনো প্রচলিত ধারণা, বহুকাল ধরে চলে আসা কোনো পদ্ধতিও সময়ের নিষ্ঠুরাঘাতে ক্রমে ক্রমে অনুপযোগী বা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ে। তখন সময়ের চাহিদা অনুসারে সেই গতানুগতিক ধারণার উপযুক্ত পরিবর্তন ঘটানো খুবই প্রয়োজন ।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির এই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বোঝা ও সময়ের সাপেক্ষে তা রূপায়ন করা খুবই জরুরি । মানুষ আজ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আশীর্বাদে সভ্যতার স্বর্ণশিখরে উন্নীত হয়েছে । তাই তাদের প্রত্যাশারও অনেক পরিবর্তন এসেছে । এখন আর ধর্মঘট, হরতালের রাজনীতি মানুষের কাছে প্রতিবাদের উপায় হিসেবে বিবেচিত হয় না । বামফ্রন্ট দীর্ঘদিন শ্রমিকদের স্বার্থে, তাদের ন্যায্য অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে । এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ শ্রমিকদের হাতে আজকে বিরাট না হলেও অন্ততঃ কিছু অর্থ সঞ্চিত হয়েছে । তাই তাদেরও আগের তুলনায় হরতাল, ধর্মঘট করার প্রয়োজন বা ইচ্ছে আগের থেকে অনেকটাই কমেছে । স্বভাবতই তাদের একটা বড় অংশ এখন ধর্মঘটে সামিল হতে অনিচ্ছুক । ধর্মঘট একটা প্রতিবাদের মাধ্যম ঠিকই, কিন্তু তাতে যেহেতু তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া হয় না, তাই মানুষ এখন ধর্মঘটকে বিশেষ গুরুত্ব দেয় না।
কেন্দ্রীয় সরকারের ৫০০ এবং ১০০ টাকার নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে সারা দেশেই একটা অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে, একথা বলার অপেক্ষা রাখে না । ভারতবর্ষের মত জনসমুদ্রের দেশে প্রধানমন্ত্রীর এই অকস্মাৎ সিদ্ধান্তে অন্ততঃ ৭০% মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলের মানুষ এই তুঘলকি সিদ্ধান্তে খুবই অসহায় । তাদের অনেকেরই হয়তো ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টও নেই। বা যাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট আছে, সেই অঞ্চলে হয়তো এটিএম এর সংখ্যা একটা কি দুটো , যেগুলোতে হয়তো এই নোটের অপ্রতুলতার কারণে অধিকাংশ সময়েই বন্ধ । এর ফলে তারাও অশেষ দুর্গতির শিকার । নিকটাত্মীয়কে হাসপাতালে ভর্তি করাতে, ছেলেমেয়েকে স্কুল-কলেজে ভর্তি করাতে, বিবাহের প্রয়োজনে বা সাংসারিক খরচ চালাতে সবাই বিরাট সমস্যার সম্মুখীন । এমতবস্থায় একদিন ধর্মঘট হওয়া মানে জনজীবন স্তব্ধ হয়ে যাওয়া । যানবাহনের সমস্যা থেকে শুরু করে দোকান পাট, হাট বাজার সবই বন্ধ হওয়াতে এই নোটসংকটের দিনে আরো বেশি দুর্ভোগ । টাকার সমস্যাতে মানুষ এমনিতেই বিভ্রান্ত, তার ওপরে ধর্মঘট হলে একেবারে গৃহবন্দী অসহায় । তাই এই ধর্মঘট ডাকার যুক্তিসঙ্গত কারণ খুব একটা ছিল বলে মনে করি না ।
স্বভাবতই বাংলার মানুষের মধ্যে এই ধর্মঘট নিয়ে একটা নেতিবাচক মনোভাবই প্রথম থেকে ছিল । তাই বন্ধের দিন তারা যথাসম্ভব নিজেদের স্বাভাবিক কর্মজীবনই বজায় রাখতে চেয়েছে । সেই কাজে তারা যে প্রায় সফল, তা ধর্মঘটের সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়ার পরে বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান বিমান বসুর বক্তব্যেই পরিষ্কার,”আমরা ভেবেছিলাম মানুষের থেকে প্রত্যাশামাফিক সাড়া পাবো । কিন্ত তা পাইনি । আমাদের যথেষ্ট বিবেচনা করেই ডাকা উচিত ছিল। আমরা এই ভুল থেকে শিক্ষা নিলাম”। অর্থাৎ এই ধর্মঘটের সিদ্ধান্তটাও বামফ্রন্টের মত একটা যুক্তিবাদী, নিয়মনীতিশীল দলের কাছে একপ্রকার খামখেয়ালি সিদ্ধান্তই বটে। অনেক বামপন্থী মানুষ, যারা আজও নিজেদের বামপন্থী বলে গর্ব অনুভব করেন, কর্মী-নেতা, সমর্থক থেকে বিবেক, মূল্যবোধ, মনুষ্যত্ব কেনাবেচার দিনেও বামফ্রন্ট ও বামপন্থীদের পাশেই আছেন, শাসক দলের হাজার প্রলোভন বা হুমকি,শাসানির মুখেও নিজেদের সর্বস্ব, এমনকি জীবন পর্যন্ত বাজি রেখে পার্টির কাজ করে চলেছেন, তারা ও সেদিনের এই হঠকারী ধর্মঘটের সিদ্ধান্তে বিস্মিত বা ক্ষুব্ধও । কারণ জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য টাকার এই সংকটের দিনে ধর্মঘট ডাকা প্রকারান্তরে মানুষের দুর্ভোগ, দুর্গতিকে লাঘব করানয়,বরংতা আরো বাড়িয়ে দেওয়াই বটে । আর যদি বা তর্কের খাতিরে ধরেই নিলাম,যে ধর্মঘট ডাকাটা প্রাসঙ্গিক,সেই ধর্মঘট কে সফলভাবে পরিচালিত করার মত শক্তি এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের নেই। তাই দিনের শেষে বিমানবাবুর ধর্মঘট সফল হয়নি বলে যে বিবৃতি দিলেন,তাতে শুধু বামফ্রন্টের চেয়ারম্যান হিসেবে বিমানবাবুরই নয়,পশ্চিমবঙ্গে গোটা বামফ্রন্টেরই মুখই যে একপ্রকার পুড়লো,তাতে কোন সন্দেহ নেই। আর এতে বাংলায় বামফ্রন্টের সাংগঠনিক শক্তির দৈনতাও একরকম স্পষ্ট হল বৈকি !!
এই অবস্থায় অবিলম্বে পার্টির উচিত কেন্দ্রে ও রাজ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট অভিমুখ নির্ণয় করা ও একজন সুযোগ্য নেতার নেতৃত্বে সেই অভিমুখে পার্টিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে আঁকড়ে থেকে নয়, বরং সময়ের সাথে সেই ধ্যান ধারণার পরিবর্তন ঘটিয়ে তাকে সময়োপোযোগী করে তোলা এবং তা সফল ও সার্থকভাবে প্রয়োগ করা । তবে সব ক্ষেত্রেই মূল লক্ষ্য টা যেন স্থির ও সুনির্দিষ্ট থাকে এবং সেই লক্ষ্যে পৌঁছতে গিয়ে যেন বাংলার মানুষের কাছ থেকে কোনভাবেই সরে যেতে না হয়। গ্রামাঞ্চলের মানুষ কেন্দ্রের সরকারের নোট বাতিলের এই অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তে প্রায় সকলেই নানা দুর্ভোগের শিকার। তাই ধর্মঘট না ডেকে মিটিং-মিছিল করে বা স্থানীয় কোন নেতা,যার জনসংযোগ ভাল, তার নেতৃত্বে সেই মানুষদের পাশে দাঁড়ানো। তাদের দৈনন্দিন সমস্যার ভার যতটা সম্ভব লাঘব করা। তবেই মানুষের সঙ্গে জনসংযোগ নিবিড় থেকে নিবিড়তর হওয়া সম্ভব। তবেই ক্রমে ক্রমে মানুষের আস্থা অর্জন করা বাস্তবায়িত হবে।

ফ্লিপকার্টের নানা আকর্ষণীয় অফার। জানতে ক্লিক করুন। পছন্দমতো জিনিস কিনুন অনলাইনে।