কথাঞ্জলির আড়ালের কথা

সব্যসাচী কুণ্ডু

 

আচ্ছা নন্দদা, কথাঞ্জলি মানে কী ? নন্দদা চিকুর মোবাইলে নতুন ডাউনলোড করা একটা গেম খেলছিল। আমার প্রশ্নটা শুনে খিঁচিয়ে উঠে বলল,-“কত টন গোবর আছে তোর মাথায়। মানে আবার কী, কথাঞ্জলি মানে কথার অঞ্জলি। সেটাও বুঝিস না।” চিকু দেখলাম দাঁত বের করে হাসছে আর কথার সায় দিচ্ছে।

আমাদের পার্কের বট গাছটার নিচে আমরা কজন, মানে নন্দদা, চিকু,ফাল্গুনী, রানা আর আমি আড্ডা মারছি । যা গরম পড়েছে বাড়িতে টেকা যাচ্ছে না । দিন রাত্রি বাড়ির অন্ন ধ্বংস করছি আর এই পার্কের ঠেকে বসে আড্ডা মারছি । কলেজের পাট সবারই চুকে গেছে। এখন চাকরি নামক মরীচিকার পেছনে ছুটে ছুটে আমরা ক্লান্ত। এই ঠেকে বসলেই খানিক আরাম পাওয়া যায় আর আমাদের পরম পূজনীয় শ্রী শ্রী নন্দ মহারাজের ফ্রি অফ কষ্ট জ্ঞান পাওয়া যায় । আজকাল ভজনের দোকানে খুব একটা যাই না। ভজনের মাকে কত করে বললাম একটা অন্তত টেবিল ফ্যান লাগাও। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এই গরমে ভজনের ওই ঘুপচি ঘরে কি বসা যায়।

নন্দদার উত্তরটা শুনে আরও একটা প্রশ্ন করার খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু যদি আবার রেগে যায় তাই ঠিক সাহস হচ্ছিল না। যাই হোক ভয় কে জয় করে আরও একটা প্রশ্ন করলাম , “ আচ্ছা এই কথাঞ্জলিতে নাকি খুব ভালো ভালো জ্ঞানের কথা লেখা আছে। ওটা পড়লে নাকি জীবনে সফল হওয়া যায়।” ফাল্গুনী আমার পাশেই শুয়ে ছিল। আমার কথাটা শুনে তড়াক করে উঠে এসে বলল , “তোর মুণ্ডু, যত গাঁজাখুরি কথা লেখা আছে , ওটা পড়লে উন্নতি করবি কী রে, জাহান্নামে যাবি। যখন সব সেট হয়ে গেছে তখন আর আপসেট হোয়ো না। কোনও মানে হয়?” আমি এই ক্ষণটারই অপেক্ষায় ছিলাম। কে না জানে নন্দদা আজকাল পিসিমনি কে কী রকম ভক্তি শ্রদ্ধা করে , যদিও নন্দদা লাল নীল বেগুনী কোনও দলেরই লোক নয়। তবুও ফ্যান বলে একটা কথা আছে না। ফাল্গুনীর কথাটা শুনে নন্দদা তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল “দেখ ফাল্গুনী যেটা জানিস না সেটা নিয়ে বেশি পাকামো করা ঠিক না। তুই পড়েছিস বইটা? না জেনে শুনে এই রকম মন্তব্য করা কি তোর সাজে?” ফাল্গুনী খানিক ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলল , “ না পড়িনি তবে ওই পেপারে বেরিয়ে ছিল না ! , সেটা পড়েই তো বলছি । পেপার-ওয়ালারা যদি ভুলভাল লেখে তাহলে আমার কী দোষ বল।’

kathanjali2

শুনে নন্দদা একটু শান্ত হল । বিজ্ঞের মতো বলল , “এই কথাঞ্জলির ইতিহাস সম্পর্কে কিছু জানা আছে তোদের ?” চিকু ফিসফিস করে বলল, “এই গুল শুরু হল।” ভাগ্যিস নন্দদা কথাটা শুনতে পায়নি। না- হলে চিকুর কপালে আজ দুঃখ ছিল। নন্দদা বলল তোর ফাইন হিসাবে সবার জন্য আইসক্রিম আনানোর ব্যবস্থা কর। খুব গরম রে ভাই। ফাল্গুনী সুবোধ ছেলের মতো পকেট থেকে টাকা বের করে আমার হাতে দিয়ে বলল , “যা ন্যপা পাঁচটে আইসক্রিম নিয়ে আই। রানা এতক্ষণ ঝিমচ্ছিল আইসক্রিমের কথা শুনে তড়াক করে উঠে এসে বলল , “ চল ন্যপা আমিও যাই তোর সাথে ।” নন্দদা রেগে গিয়ে বলল , “ন্যপা কি কচি খোকা না কি , একা একা আইসক্রিম আনতে পারবেনা । তুই এই বোতলটা নিয়ে যা, কল থেকে জল ভরে নিয়ে আয়।” আমি ঝন্টুদার দোকানে ছুটে গেলাম আর উড়ে এলাম , এই আইসক্রিম আনার চক্করে গল্পটা না মিস করে যাই।

আইসক্রিম খেয়ে নন্দদা শুরু করলো , “ তোরা তো জানিস মাস খানেক আগে আমি কলকাতায় বড় মামার কাছে গেছলাম। আমার বড় মামার সাথে মন্ত্রী আমলাদের খুব ভাব। আমাদের পিসিমনিও মামাকে খুব স্নেহ করেন , সেই সুবাদেই একটা অনুষ্ঠানে পিসিমনির সাথে দেখা করার সৌভাগ্য হয়েছিল। মামা পরিচয় করিয়ে দেবার পর উনি আমার সাথে খানিক একান্তে কথা বললেন। কথায় কথায় উনি জিজ্ঞেস করলেন আমি কতদূর পড়াশোনা করেছি , চাকরি বাকরি করি কিনা। আমি বললাম এক বছর হল গ্রাজুয়েশন করেছি, চাকরির পরীক্ষা টরীক্ষা দিচ্ছি। এখন এই এল আই সির এজেন্ট হিসাবে কাজ করি। শুনে উনি খুব খুশি হলেন। বললেন কোনও কাজকেই ছোট মনে করো না।  জান তো, পান বিড়ি চপের দোকান করেও গাড়ি বাড়ি করা যায় । যখন সব সেট হয়ে গেছে তখন আর আপসেট হয়ো না। আমি পিসিমনি কে আর একবার গড় করে প্রণাম করে বললাম, আপনার জীবনটা তো সংগ্রামে ভরা। লড়াই করে সংগ্রাম করে আজ এখানে এসেছেন। আমার একটা ছোট্ট আনুরোধ যদি রাখেন। উনি খুশি হয়ে বললেন, বলো। আমি বললাম , আপনি যদি আপনার সংগ্রামী জীবনের সারমর্ম দিয়ে একটা বই লেখেন তাহলে সেই বই পড়ে আমরাও কিছুটা আশার আলো দেখতে পাব। বেকার ভাই- বোনেরা এই বই পড়ে জীবনে সংগ্রাম করতে শিখবে , নিজেকে জানবে বুঝবে জীবনে উন্নতি করবে। আমার কথা শুনে উনি খুব খুশী হলেন। বললেন, এটা খুব ভালো কথা,তোমার কথা আমি নিশ্চয়ই রাখবো। তবে কী জানো, এই বিরোধী গোষ্ঠী আর সংবাদ পত্রের লোক গুলো এতো পেছনে লাগে যে এই সব নিয়ে ভাবার সময়ই পাই না। কিন্তু তুমি বাছা খুব ভালো আইডিয়া দিয়েছ , সত্যি তো বেকার ছেলেদের জন্য যদি কিছু না করি তাহলে তো আমার বদনাম। খুব তাড়াতাড়ি আমি এই রকম একটা বই বার করার চেষ্টা করছি।

mamata6

নন্দদা এবার আমাদের বলল , “দেখলি তো বইটা যা তা বই নয়।বইটায় অনেক ভালো ভালো বানী লেখা আছে। তাছাড়া বইটার পেছনে আমারও খানিকটা অবদান আছে , কি বলিস?” চিকু দেখলাম মুখ টিপে সেই ফিচেল হাসিটা হাসছে। নন্দদা বলে চলল , “কদিন আগে একটা পেপারে পড়ছিলাম , পিসিমনির নাকি ইতিহাসে জ্ঞান খুব কম। উনি নাকি বলেছেন যে,কবিগুরুর সাথে কিটস আর সেক্সপিয়ারের সখ্যতা ছিল। আসলে সংবাদ পত্রের লোকগুলোর বুদ্ধি বলে কিছু নেই। সব কটা মূর্খ। শুধু কুৎসা ছড়ায় । আসলে কবিগুরুর সাথে কিটস আর সেক্সপিয়ারের ট্যলিপ্যাথিতে যোগাযোগ ছিল। উনি নিয়মিত ওনাদের সঙ্গে কথা বলতেন। কবিগুরু এত এত নাটক কবিতা গল্প লিখে গেছেন তাতে ওনাদের অবদান কি কম রে ভাই। আসল আইডিয়াটা তো ওনারাই দিতেন। ঠিক তেমনি আমাদের পিসিমনিরও অনেক মহাপুরুষের সাথে ট্যলিপ্যথিতে যোগাযোগ আছে। এখন যেমন দাবাং২ ধুম২ বেরোচ্ছে আমাদের কবিগুরুরও গীতাঞ্জলি ২ লেখার খুব ইচ্ছে ছিল। কিন্তু কোনও কারণে সেটা হয়ে ওঠেনি। তাই উনি পিসিমনিকে অনুরোধ করেছিলেন ওটা লেখার। আজকের দিনে পিসিমনির মতো সাহিত্যিক আর কজন আছেন  বলতো। জানিস রামকৃষ্ণ দেবও বলেছিলেন কথামৃত            ২ লেখার জন্য। কিন্তু পিসিমনির হাতে অনেক কাজ, ব্যস্ত মানুষ । তাই উনি দুজনার অনুরোধ রেখে কথাঞ্জলি লিখে ফেললেন। এই হল কথাঞ্জলির আসল ইতিহাস। আর নিশ্চয়ই তোরা বইটাকে যা তা বই বলবি না।” আমরা সবাই একসাথে মাথা নেড়ে বললাম , না আর কক্ষনও বলব না।

তবে আমি আজ দুপুরে দাদার ল্যপটপ থেকে ফ্লিপকার্টে একটা কথাঞ্জলির অর্ডার করে দেব। কী জানি, এই ইতিহাস জানার পর যদি বইটা বাজারে না পাওয়া যায় ।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.