দিব্যেন্দু দে
চারিদিকে আলোর রোশনাই। সকাল থেকে পটকার আওয়াজও ভেসে আসছে। শিলিগুড়ি শহরে ঢুকতেই দেখি, উচু উচু বাড়ি থেকে ঝুলছে নানা রকমের আলো। সন্ধে নামতে না নামতে সেগুলো জ্বলেও উঠল।
কিন্তু সব আলো যেন ম্লান হয়ে গেল একটা মুহূর্তের কাছে। রাতের বাস ধরে যাওয়ার কথা বালুরঘাট। এন বি এস টি সি আগে রাতে বেশ কয়েকটি বাস চালাত। এখন কমতে কমতে সবেধন নীলমণী একটিতে দাঁড়িয়েছে। সেই বাসেই টিকিট কাটলাম। তারপরই দেখলাম, বাসের চালক মোমবাতি জ্বালাচ্ছেন।
তাঁকে বললাম, শুভ দীপাবলি। তিনিও বললেন। একটু একটু করে আলাপ জমে উঠল। কোথাও যেতে যেতে পথচলতি মানুষের সঙ্গে আলাপ করা, গল্প করার একটা নেশা সেই ছোট থেকেই। এভাবেই জীবনের কত বন্ধুকে খুঁজে পেয়েছি। তাঁদের অনেকের সঙ্গে এখনও যোগাযোগ আছে। কিন্তু আজ অবাক হলাম ড্রাইভার সাহেবকে দেখে। নাম জিজ্ঞেস করতেই জানতে পারলাম, মফসার মোল্লা। নামটা শুনে কিছুটা চমকে গেলাম। দীপাবলির প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন একজন মুসলিম ভদ্রলোক!
অথচ, দুদিন আগে ধর্ম নিয়ে কত কাণ্ডই না হয়েছে। বিহার ভোটকে কেন্দ্র করে কত হিংসাই না ছড়ানো হল। উন্নয়নের অ্যাজেন্ডাকে ভুলে গিয়ে গরু নিয়ে পড়লেন অমিত শাহরা। বিহারে বিজেপি হারলে নাকি পাকিস্তানে পটকা ফাটবে। বারবার খেলতে চাইলেন ধর্মীয় তাস। তার ফলটাও অবশ্য হাতেনাতেই পেয়েছেন।
থাক তাঁদের কথা। মফসার মোল্লার কথায় আসি। বাড়ি কুমারগ্রামের সমঝিয়া গ্রামে। বয়স আনুমানিক ৪০। এন বি এস টি সিতে কাজ করেন। তবে চাকরি এখনও পাকা নয়। পাকা হবে, এমন ভরসাও নেই। তিনি কেন প্রদীপ জ্বালাতে গেলেন ? তিনি কখনও ভোটে দাঁড়াবেন না। তাঁর নিজেকে ধর্ম নিরপেক্ষ প্রমাণ করার কোনও দায় নেই। তিনি যা করেন, মন থেকেই করেন। মফসার ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম, এটা তাঁর কাছে নতুন কিছু নয়। আগে বেসরকারি বাস চালাতেন। দীপাবলির দিনে সেই বাসেও মোমবাতি জ্বালাতেন। তাঁর বাড়িতেও আকি আজকের দিনে মোমবাতি জ্বলবে।
কেন জ্বালান এই মোমবাতি ? সহজ সরল মানুষের সহজ উত্তর ‘আমার বাড়ি যেন ভাল থাকে। আমার গাড়ি যেন ভাল থাকে।’ আজ বাঙালির কালীপুজো। পাড়ায় পাড়ায় বাজছে শ্যামাসঙ্গীত। এর মধ্যে অনেক গান লিখেছেন কাজি নজরুল ইসলাম। আমরা কজন সেটা জানি ? মফসার মোল্লাদের কথাই বা কজন জানি! তাঁরা আড়ালেই থেকে যান। যারা গো মাতা পুজো করতে যাচ্ছিলেন, যাঁরা ধর্মের নামে ভাগাভাগি করছিলেন, তাঁরা প্লিজ এসে মফসার মোল্লাদের থেকে যান। কলকাতার রাস্তায় বুদ্ধিজীবীরা কত মোমবাতিই না জ্বালিয়েছিলেন। এই মোমবাতির কাছে তাঁদের সব মোমবাতি ম্লান। এমনকি এত আলোর রোশনাই! তাও ম্লান।