সত্রাজিত চ্যাটার্জি
এতোদিন ঘরে নাটক দেখতাম, শুনতাম। বিগত এক মাস ধরে বাইরেও দেখছি সেই একই নাটক । কীসের নাটক ? জনগণ কে নিজের প্রাণ সংশয়ের গল্প বলার নাটক। জনগণকে নিজের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার গল্প বলার নাটক। এতদিন ঘরে মানে বাংলার রাজনীতিতে বিরোধী নেত্রীর মুখে শুনতাম। বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে সেই নাটক দেখানোর অভ্যাস একেবারে যে বন্ধ হয়েছে ,তা বলা যাবে না। গত সপ্তাহেই বিমানের যান্ত্রিক ত্রুটিকে তিনি অভ্যাসবশতঃ তাকে পরিকল্পনা করে খুন করার চেষ্টা বলে দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিমানের তিনজন পাইলটকে এজন্য সেই এয়ারলাইন্স অথরিটি সাসপেন্ডও করেছে শুধুমাত্র অভিযোগের ওপর ভিত্তি করেই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর অভিযোগ বলে কথা !!
অপরদিকে বাইরে মানে দিল্লির মসনদেও বিগত একমাস ধরে চলছে সেই এক অভিনয়। প্রধানমন্ত্রীকে নাকি কেউ বা কারা হুমকি দিচ্ছে খুন করার। তিনি নাকি যে কোনও দিন খুন হয়ে যেতে পারেন। আর তাঁকে নাকি সংসদে বিরোধী রাজনীতিকরা বলতে দিচ্ছে না কিছু। ইত্যাদি ইত্যাদি।
কেন এই অভিনয় ? এর কারণ হলো এইসব প্রহসন,অভিনয়ের দরকার হয়, যখন কোনও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থেকে জনগণের দৃষ্টি ঘোরানো আবশ্যক হয়ে পড়ে। অতীতে বাংলার বিরোধী দলনেত্রী দিবারাত্রই দাবি করতেন, তদানীন্তন বাংলার ক্ষমতাসীন দল সি পি এম নাকি তাঁকে খুন করার চক্রান্ত করছে। সেখানে অবশ্য কিছুটা সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা এবং জনসমক্ষে সি পি এম তথা বামফ্রন্টকে হেয় প্রতিপন্ন করাই তাঁর উদ্দেশ্য ছিলো। কিন্তু যিনি বিধানসভায় ঢুকে বিধানসভা ভাঙচুর করার মত সাহস দেখাতে পারেন, পুলিশের সামনেই তাঁর দলের আর একজন “সুযোগ্যা সদস্যা” ও বিধায়িকা অশ্রাব্য ভাষায় পুলিশকে গালিগালাজ করে জিভ টেনে ছিড়ে ফেলার হুমকি দিয়েও গ্রেপ্তার হওয়া থেকে পার পেয়ে যেতে পারে, সেই বিরোধী দলনেত্রীকে সি.পি.এম লুকিয়ে খুন করতে যাবেই বা কেনো ? কিছু করার হলে তো পুলিশ তখনই যা করার করতে পারতো? আসলে উদ্দেশ্যটা খুব স্পষ্ট ছিল যে এসব করে অহরহ মিথ্যে কথা বলে জনগ্ণ এর কাছে সহানুভূতি লাভের চেষ্টা এবং ক্ষমতাসীন দল বামফ্রন্টের মুণ্ডপাত করা ও জনগণের মনে সেই বিশ্বাস গড়ে তোলা। তার উদ্দেশ্য এবং প্রয়োগনীতি যে পুরোপুরি সফল তা তো ২০১১ তে বিধানসভা ভোটের ফল দেখলেই বোঝা যায়। অথচ সত্যিকারের খুন করার চেষ্ট হয়েছিলো বিগত বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে। জঙ্গলমহলে দলীয় সভা সেরে ফেরার পথে ভাদুতলার কাছে মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের ঠিক পাশেই ল্যান্ড মাইন বিস্ফোরণ ঘটায় মাওবাদীরা, যে মাওবাদীরা পশ্চিমবঙ্গে ২০১১ সালে রাজনৈতিক পালাবদলে বিশাল একটা ভূমিকা নিয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল তৃণমূলের সাথে অঘোষিত গাঁটছড়া বেঁধে। অল্পের জন্য সেদিন প্রাণে বেঁচেছিলেন বুদ্ধবাবু। বা এর অনেক আগে জ্যোতি বাবু ও তার দেহরক্ষীর ওপরেও পাটনা স্টেশনে হামলা চালিয়েছিলো কিছু অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীরা-(মতান্তরে আনন্দমার্গীরা)। জ্যোতিবাবু ্্্্্্্্্্্্রক্ষা পেলেও তাঁর দেহকর্মী গুলির আঘাতে মারা যান। অথচ ৩৪ বছরে বিরোধী নেত্রীর ওপরে হামলা তো দূরের কথা বরং দিনের পর দিন একপ্রকার প্রশ্রয়ই দিয়ে গিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার। সিঙ্গুরে সরকারী কাজে বাধা দিয়ে দিনের পর দিন তিনি ধর্মতলাতে মাচা বেঁধে অনশনের নামে “প্রহসন” করেছিলেন পুলিশ দিয়ে সেই অনশন মঞ্চকে কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য উচ্ছেদ করাননি। আর তদানীন্তন সেই বিরোধী নেত্রী যিনি ২০১১ এর বিধানসভা ভোটের আগে একটি দলীয় সভাতে দাঁড়িয়ে নিজের গুণ্ডা কন্ট্রোল করার ক্ষমতার কথা ফলাও করে বলতে পারেন, তার পেছনে গুণ্ডা লাগিয়ে তাকে খুন করাতে পারে, কার এতো ক্ষমতা ?
দেশের প্রধানমন্ত্রীও ইদানীং সেই একই অভিযোগ করতে শুরু করেছেন। তাঁকেও নাকি খুন করার পরিকল্পনা চলছে। উদ্দেশ্য একটাই। নোট সংকটে বিভ্রান্ত দেশের জনগণের সহানুভূতি লাভের চেষ্টা। প্রধানমন্ত্রীর ৫০০ ও ১০০ টাকার নোট নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত যে বুমেরাং হয়ে তাঁর কাছেই ফিরে এসেছে, সেই ছবিটা এই ১ মাসে বেশ পরিষ্কার। ইতিমধ্যেই প্রায় ১০০ জন অসহায় মানুষের মৃত্যু হয়েছে ব্যাঙ্কের টাকা তোলার লাইনে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে। টাকার জোগান সঠিক সময়ে করতে না পেরে অশেষ দুর্গতির মুখে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। পরোক্ষভাবে এই মৃত্যু ও দুর্ভোগের দায় প্রধানমন্ত্রীর ওপরেই বর্তায় বৈকি ! তাই মরীয়া প্রধানমন্ত্রী দেশের জনগণের সহানুভূতি পেতে, মানুষের দৃষ্টি এই নোট বিভ্রাট থেকে সাময়িক বিচ্যুত করতে খুন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা প্রাকাশ করছেন প্রেস মিট করে। অথচ দেশের একজন ভি.ভি.আই.পি তিনি। গাছ থেকে একটা পাকা পেয়ারা মাটিতে পড়ে যাওয়ার স্বাভাবিক ঘটনার মত যে কোন দিন তিনিও খুন হয়ে যেতে পারেন, এই কথা কি আদৌ বিশ্বাসযোগ্য ? তিনি আরও অভিযোগ করেছেন সম্প্রতি যে, তাঁকে নাকি সংসদে বলতে দিচ্ছে না বিরোধী দলের সাংসদরা। এখানেও সেই “সততার অভিনয়” ছাড়া আর কিছুই নেই। দিনের পর দিন তিনি সংসদে আসতেন না, নোট সংকট নিয়ে বিরোধী দলের সাংসদদের প্রশ্নবাণ এড়াতে। সেই নিয়ে পাহাড় প্রমাণ অভিযোগ তো ছিলই বিরোধীদের। একদিন হাজির হলেন। আর একদিনের অভিজ্ঞতাতেই তার চমকপ্রদ অভিযোগ, বিরোধী সাংসদরা নাকি তাকে কিছু বলতে দিচ্ছে না ! আদৌ বিশ্বাসযোগ্য এই অভিযোগ ? লোকসভার স্পিকারও তো তাঁর দলেরই । যদি অভিযোগ সত্যিই হয়, তো স্পিকার কি করছিলেন তখন ? আর লোকসভাতে ৩০০ এরও বেশি দলীয় সাংসদ তাঁর দল বিজেপির ই। তবুও তিনি ব্রাত্য সেখানে ? যারা ২০১৪ সালে কেন্দ্রের সরকারে এসেই সাধারণ মানুষ এবং দেশের বিশিষ্টজনের বাকস্বাধীনতার ওপরে বিধি নিষেধ জারি করেছে, তাদের কোন সিদ্ধান্তের কেউ প্রতিবাদ করলেই তাকে ‘পাকিস্তানের এজেন্ট’, ‘দেশদ্রোহী’ ইত্যাদি তকমা দেওয়া হচ্ছে, সেই দলের সর্বোচ্চ নেতা তথা দেশের প্রধানমন্ত্রীর বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিচ্ছে বিরোধীরা—একথা কোনমতেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।
আসলে উদ্দেশ্য একটাই। জনগণের সহানুভূতি লাভের চেষ্টা। একজন বাংলায় বিরোধী নেত্রী থাকার সময় অহরহ করতেন। এখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হয়েও মাঝে মাঝে পুরোনো অভ্যাসের বশবর্তী হয়ে পড়েন। আর একজন ৩০০ এর বেশি আসনে জেতা দল থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে চাপের মুখে সেই একই রীতি অবলম্বন করেছেন। ঘরের নাটকটা এখন বাইরেও সমধিক অভিনীত।