এই পথে একা একা হাঁটতেন বিভূতিভূষণ

নামেই ভিনরাজ্য। আসলে, ঘরের কাছেই গালুডি। ছোট্ট ছুটিতে বেরিয়ে পড়ুন। হদিশ দিলেন স্বরূপ গোস্বামী।।

মাইলের পর মাইল জুড়ে ঘন জঙ্গল। পাকদন্ডি বেয়ে উঠে যান পাহাড়ে। আর সেই পাহাড়ে উঠে যদি পেয়ে যান আস্ত একটা লেক!

ধরুন আরও একটু অন্য পথে গেলেন। জঙ্গলের বুক চিরে হাঁটতে হাঁটতে পেয়ে গেলেন একটা ঝর্না।

পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসবেন? নির্জন স্টেশন পেরিয়ে পেয়ে যাবেন আদিবাসী পল্লী। আরও একটু দূরে গেলে পাবেন কুলকুল করে বয়ে চলা সুবর্ণরেখা নদী।

একটু সাহিত্যের গন্ধ চান ? বেশ, বিভূতিভূষণের সেই বাড়ি থেকে ঘুরে আসুন। সামনের রাস্তাটির নাম ‘অপুর পথ’।

galudih2

একসঙ্গে এত কিছু! হ্যাঁ, আরও অনেক কিছু অপেক্ষা করে আছে আপনার জন্য। নিজ রাজ্যে নয়। তবে ভিন রাজ্য শুনে ঘাবড়ে যাওয়ার কিছু নেই। আসলে, ওটা বাঙালিদেরই জায়গা। হলপ করে বলা যায়, এত বাংলা আপনি কলকাতায় শুনতে পাবেন না।

জায়গাটার নাম তাহলে বলেই ফেলি। গালুডি। হয়ত নাম শুনেছেন। কলকাতা থেকে ট্রেনে যেতে ঘণ্টা তিনেকের পথ। ঘাটশিলার পরের স্টেশন। হাওড়া ও সাঁতরাগাছি থেকে অসংখ্য ট্রেন। টাটাগামী ট্রেনে চেপে পড়লেই হল। রিজার্ভেশন নেই ? চিন্তার কিছু নেই। তিন ঘণ্টার রাস্তা। দেখতে দেখতেই এসে যাবে। যাঁরা দক্ষিণবঙ্গের অন্যান্য দিক থেকে আসবেন, তাঁরা খড়্গপুর চলে আসুন। সেখান থেকে ঘণ্টা দেড়েকের পথ। গালুডি খুব বড় মাপের স্টেশন নয়। ফলে, সব ট্রেন দাঁড়ায় না। সেক্ষেত্রে ঘাটশিলায় নেমে পড়ুন। সেখান থেকে অটো বা বাসে মিনিট পনেরোর রাস্তা।

ভাবছেন, ঘাটশিলায় না থেকে গালুডিতে কেন? হ্যাঁ, ঘাটশিলায় অনেক হোটেল আছে, এটা ঘটনা। সেখান থেকে অটোতে আশপাশের জায়গাগুলো ঘুরতে পারেন, এটাও ঠিক। তবু ঘাটশিলা তো একটা শহর। আপনি তো যাচ্ছেন প্রকৃতির সান্নিধ্যে। তাহলে আর শহরের ভিড়ের মধ্যে থাকবেন কেন ? চলে আসুন নির্জন গালুডি।

হয়ত ভাবছেন, ছোট জায়গায় থাকার ব্যবস্থা হবে কিনা। এ নিয়েও বেশি দুশ্চিন্তা না করাই ভাল। আপনার বাজেট অনুযায়ী ঠিক ব্যবস্থা হয়ে যাবে। যদি একটু বেশি খরচ করতে চান, আপনার জন্য আছে গালুডি রিসর্ট। বিলাসের সব উপকরম সেখানে হাজির। মাঝামাঝি খরচের কিছু হোটেল আছে। অনেকে বাড়িতেও টুরিস্ট রাখেন। যদি আরও কম খরচে থাকতে চান, তাহলে স্টেশনের কাছেই পেয়ে যাবেন ধর্মশালা। মাটির উপর তাকিয়া পাতা। মাথাপিছু পঁচিশ টাকা দিলেই হবে। ধরা যাক, আপনারা দুজন গেলেন। সেক্ষেত্রে ঘরের ভাড়া মাত্র পঞ্চাশ টাকা। তবে একটা ছোট্ট শর্তের কথা বলে রাখা যাক। ওই ধর্মশালায় আমিশ খাবার নিয়ে ঢোকা নিষেধ। মদ্যপানের ইচ্ছে থাকলে, তাহলে ওই ধর্মশালা আপনার জন্য নয়।

galudih4

তাহলে, বেরিয়েই পড়ুন। স্টেশন পেরিয়ে চলে যান সুবর্ণরেখার তীরে। কুলকুল করে বয়ে চলেছে সুবর্ণরেখা। ঋত্বিক ঘটকের সেই সুবর্ণরেখা মনে পড়তেই পারে (অবশ্য যদি দেখা থাকে, তবেই মনে পড়ার প্রশ্ন)। এখন নদীর উপর বড় সেতু হয়েছে। স্রোত কিছুটা নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তবে ব্যারেজের উপর থেকে জলাধার দেখার একটা আলাদা রোমাঞ্চ আছে। সেখানে জলের গর্জন একটা অন্য মাত্রা এনে দেবে। বসে থাকুন গণ্টার পর ঘণ্টা। কোথাও কোথাও জলের গভীরতা ভালই। ইচ্ছে হলে সুবর্ণরেখায় স্নান করতে নেমেও পড়তে পারেন।

চারিদিকে একটা গ্রাম গ্রাম ভাব। আদিবাসী পাড়ায় চলে যান। চাইলে মহুয়ায় মজে যেতে পারেন। যদি আদিবাসী রান্না খেতে ইচ্ছে হয়, তারও ব্যবস্থা আছে। পাশপাশের লোকদের জিজ্ঞেস করলেই হদিশ পেয়ে যাবেন। রেস্টুরেন্টের রান্না তো অনেক খেয়েছেন। একটা দিন আদিবাসী বাড়ির দাওয়ায় বসে খেয়ে দেখুন। এ-ও এক অন্যরকম অনুভূতি। সেই মাংসের স্বাদ আপনার জিভে লেগে থাকবে। মুরগি বা ছাগল তো আছেই, আগে থেকে বলে রাখলে ভেড়ার মাংসও পেতে পারেন।

পরের দিন সকাল সকাল একটা অটো নিয়ে বেরিয়ে পড়ুন। মোটামুটি চারশো থেকে পাঁচশো টাকা দিলেই চালক আপনাকে আশপাশের অনেকটা এলাকা ঘুরিয়ে দেবেন। বাঁ দিকে আধঘণ্টা গেলেই পেয়ে যাবেন দুয়ারসিনি। এটা অবশ্য পুরুলিয়ায়। জঙ্গল পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে আপনি বাংলা সীমান্তে ঢুকে পড়ুন।

ওই অটো নিয়েই আবার ঝাড়খন্ড সীমান্তে ঢুকে পড়ুন। চলে যান বুরুডি লেক। পাহাড়ের উপর এমন একটা আস্ত লেক! সেই লেকে বোটিং করতে পারেন। বেশ কিছু অস্থায়ী দোকান আছে। টুকটাক খেয়ে নিতে পারেন। একটু মেঘলা থাকলে বা মনোরম আবহাওয়া থাকলে লেকের ধারে নির্জনে বসেও থাকতে পারেন। ওই পাহাড়ি পথেই চলে যান ধারাগিরি। অটো যেখান পর্যন্ত যায়, সেখান থেকে দেড়-দু কিমি হেঁটে যেতে হবে। তবে, পথ হারানোর ভয় নেই। কারণ, কোনও এক আদিবাসী গাইড আপনাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে। এ আরেক বিস্ময়। চারিদিকে জঙ্গলে ঘেরা। তার মাঝেই মস্ত ঝর্না। কুলকুল করে বয়ে চলেছে। ইচ্ছে হলে, সেই পরিষ্কার, স্বচ্ছ জলে স্নান করে নিতে পারেন। একদিকে নির্জন অরণ্য, আরেকদিকে ওই ঝর্না। এমন জায়গা ছেড়ে আসতে ইচ্ছে করবে না। ওই নির্জনে এক দেড় ঘণ্টা আড্ডা দিলে অটোচালক নিশ্চয় রাগ করবেন না। তিনিও জানেন, যে ট্যুরিস্টরা ধারাগিরি যায়, দু-ঘণ্টার আগে আসে না।

galudih5

ধারাগিরি থেকে চলে আসতে পারেন ফুলডুংরিতে। ছোট্ট টিলা। ভাল লাগবে। বিভূতিভূষণ বেশ কিছুদিন এই এলাকায় চাকরি করেছেন। এই পাহাড়ে প্রায়ই হাঁটতেন। আরও একটু এগিয়ে যান। পেয়ে যাবেন বিভূতিভূষণের সেই বাড়ি। সম্প্রতি সেটা সংস্কার করা হয়েছে। তাঁর স্মৃতিতেই সামনের রাস্তাটির নাম রাখা হয়েছে অপুর পথ।

টাইম মেশিনে নিজেকে নিয়ে চলুন অনেক পেছনে। সুমনের গানের লাইনগুলো গুনগুন করে গেয়ে উঠুন – এই পথে একা একা হাঁটতেন বিভূতিভূষণ।

রাস্তার ধারে অসংখ্য ধাবা। কোথাও একটা খেয়ে নিতে পারেন। তাহলে, ফিরে আসুন গালুডিতে। হাইওয়ের উপর বাসস্ট্যান্ডের কাছে একটি বিখ্যাত ল্যাংচার দোকান আছে। সেই বিশাল আকৃতির ল্যাংচার কথাও আপনার স্মৃতিতে থেকে যাবে আজীবন।

ফেরার সময়ও তেমন ঝামেলা নেই। গালুডি স্টেশন থেকে অসংখ্য ট্রেন। ফাঁকা দেখে চেপে পড়ুন। একেবারে অন্যরকম দুটো দিন, মন্দ কী ?

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.