কয়েকদিন আগেই বেঙ্গলটাইমসে একটি লেখা লিখেছিলেন সব্যসাচী কুণ্ডু। শিরোনাম ছিলঃ নাস্তিকদের খোলা চিঠি। সেই লেখা পড়ার পর পাল্টা চিঠি লিখলেন ময়ূখ নস্কর।
প্রিয় সব্যসাচী,
আপনার চিঠি পড়লাম, যদিও আপনি আমার নাম করেননি, তবুও যেহেতু বেঙ্গল টাইমসে নাস্তিক্য সংক্রান্ত প্রবন্ধগুলি মূলত আমিই লিখে থাকি, তাই উত্তর দেওয়ার একটা দায় আমার থেকেই যায়। তাই আগ বাড়িয়ে আমিই লিখছি। প্লিজ ভাই, দয়া করে ভাববেন না আপনাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করছি।
পড়াশোনা করেছি সামান্যই, তার মধ্যে ছোটবেলায়, একটা নীতিকথার বইতে পড়েছিলাম, god helps those, who help themselves. ঈশ্বর তাঁদেরই সাহায্য করেন, যারা নিজেদের সাহায্য করেন। আমি ঈশ্বর মানি না, কিন্তু এই কথাটা পড়ে সেই ছোটবেলাতেই বুঝেছিলাম, ঈশ্বর বলে যদি কিছু থাকেন তিনি নিজের উদ্যোগেই আমাকে সাহায্য করবেন, তার জন্য আমার প্রতিদিন পূজা করার দরকার নেই। পূজা না করলেও মনের জোর বাড়ে যদি আমি নিজেকে নিজে সাহায্য করি। আমাদের দেশের এক মহামানব, গৌতম বুদ্ধ, বলেছিলেন, আত্মদীপ ভবঃ। আত্মশরণম ভবঃ। নান্য শরণম। নিজেই নিজেকে পথ দেখাও। নিজের শরণ নাও। অন্যের শরণ নিও না।
তবু জানি, মানুষের মন সততই দুর্বল, এই অনিশ্চয়তায় ভরা দুনিয়ায় সর্বদাই আশঙ্কায় ভোগে। সর্বদাই কোনও এক অদৃশ্য শক্তির কাছে প্রার্থনা জানায়, আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে। কিন্তু সত্যিই কি সেই শক্তির ক্ষমতা আছে কাউকে দুধে ভাতে রাখার? এই ধরুন না, সমুদ্রে ডুবে মারা যাওয়া সিরিয়ার ওই হতভাগ্য শিশু আয়লানের কথা। ঈশ্বরের নাম নিয়ে যুদ্ধ করছে আই এস। সেই যুদ্ধের ফলেই তাকে দেশ ছাড়তে হল। ঈশ্বরের কি দায়িত্ব ছিল না তাকে রক্ষা করার? নৌকাডুবির মুহূর্তে আয়লানের বাবা নিশ্চয়ই ঈশ্বরের কাছে প্রানপণে প্রার্থনা জানিয়েছিলেন। ঈশ্বর কি তাকে রক্ষা করলেন? ক্ষমতায় কুলালো তাঁর? নাকি তিনি আয়লানের পিতার প্রার্থনায় কোনও খুঁত আবিষ্কার করেছিলেন?
ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করার সঠিক পদ্ধতিটা কি সেটাই তো সব ধর্ম মিলে ঠিক করতে পারল না। মনে মনে প্রার্থনা করলে যে কাজের কাজ কিছু হয় না, তাঁর প্রমাণ আয়লানের মৃত্যু। কিন্তু জোরে জোরে প্রার্থনা করব কীভাবে? এ বলে এই ভাবে, ও বলে ওই ভাবে। সবাই বলে তারটাই ঠিক, অন্যটা ঘোরতর ভুল। সব ধর্ম, সব ধর্মগুরুই নিজের ঢাক পেটালেন। আমি ঠিক, আমিই ঠিক, বাকি সব ভুল।
শুধু একজনকেই জানি, যিনি বলেছিলেন, যত মত তত পথ। কিন্তু তাঁর শিক্ষার কী চমৎকার পরিণতি হয়েছে? এক ব্যক্তি, যিনি নাকি রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসী হতে চেয়েছিলেন, তিনিই গুজরাতে অন্য পথের মানুষদের কচুকাটা করলেন। (গুরুর প্রতি কী শ্রদ্ধা! ভগবানের কী ক্ষমতা!) তাঁর দল ওড়িশায় খ্রিস্টান মিশনারিকে দুই বাচ্চা সমেত পুড়িয়ে মারল, তারপর দিল্লিতে উঁচু পদ পেয়ে কখনও বোধিবৃক্ষের নীচে, কখনও রামকৃষ্ণ মিশনে ধ্যানে বসছেন। আচ্ছা আপনিই বলুন, আজ যারা বোধিবৃক্ষ বা রামকৃষ্ণ মিশনের দায়িত্বে আছেন তাঁদের কি উচিত হয়েছে বুদ্ধ বা রামকৃষ্ণের স্মৃতিধন্য স্থানে এই ব্যক্তিকে অ্যালাও করা? ভগবান থাকলে তিনি এই অনাচার সহ্য করতেন? আপনি তো হিন্দু হিসাবে গর্ব বোধ করেন, এই ব্যক্তিকে দেখে হিন্দু হিসাবে লজ্জা হয় না?
যাই হোক মূল প্রসঙ্গে ফিরি, আপনি বলছেন, নাস্তিক্য প্রচার করতে গিয়ে আমরা অন্য ধর্মকে আঘাত বা বদনাম করছি কেন? প্রথমত বলি, অন্যের বিশ্বাসে আঘাত না করলে নিজের মত কখনও প্রচার করা যায় না। যীশু যখন নিজের মত প্রচার করেছিলেন, মহম্মদ যখন নিজের মত প্রচার করেছিলেন তখন অনেকের বিশ্বাসে আঘাত লেগেছিল। নতুন মতকে তখনকার অধিকাংশ মানুষ মানতে পারেননি। গালিলিও, কোপারনিকাসের মত তো অনেকের বিশ্বাসে আঘাত করেছিল। তা হলে নাস্তিকরা নিজেদের মত প্রচার করতে পারবে না কেন?
আর আঘাতটা তো কেবলমাত্র বিশ্বাসে দেওয়া হচ্ছে, শারীরিক আঘাত তো দেওয়া হচ্ছে না। কখনও শুনেছেন, নাস্তিকরা আস্তিকদের ধরে পেটাচ্ছে? গলা কাটছে? কখনও দেখেছেন নাস্তিকরা কোনও ধর্মস্থান অপবিত্র করছে? কিন্তু আস্তিকরা একে অন্যের ধর্মস্থান ধ্বংস করে, অন্যকে হত্যা করে। গালিলিওর ওপর অত্যাচার করে, ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারে।
ধর্মে যখন দাবি করা হয়, যীশুর রক্ত থেকে মদ হয়েছিল, বুদ্ধ জন্মের পরেই হাঁটতে শুরু করেছিলেন, মহম্মদ এক রাতে মক্কা থেকে জেরুজালেম গিয়ে আবার ফিরে এসেছিলেন, মধু নামক দৈত্যের চর্বি থেকে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছিল, রাহু নামক দৈত্য পৃথিবীকে গপ করে গিলে ফেলে, হিরন্যাক্ষ নামে দৈত্য পৃথিবীকে সমুদ্রের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল, তখন নাস্তিকদের বিশ্বাসেও প্রবল আঘাত লাগে। নাস্তিকরা কিন্তু এজন্য কোনও আস্তিককে পুড়িয়ে মারে না, বরং নিজের মনে হো হো করে হাসে, আর ভাবে বুদ্ধিমান আস্তিকরা এসবের প্রতিবাদ করেন না কেন?
দ্বিতীয়ত, যে কথাটা বলব সেটার সঙ্গে আমার অনেক নাস্তিক বন্ধু একমত নাও হতে পারেন, তারা হয়তো আমাকে মধ্যপন্থী ভাববেন তবু বলি। (আসলে নাস্তিক্যে এই সুবিধাটা আছে, নাস্তিকদের কোনও পরমপুরুষ নেই, পরম গ্রন্থ নেই। তাই একজন নাস্তিকের সঙ্গে অন্য নাস্তিকের বিবাদ হতেই পারে, কিন্তু সেটা যুক্তির বিবাদ। নিজের ভুলকে নাস্তিকরা অনায়াসে মেনে নিতে পারে। একদিন সারা পৃথিবী বিশ্বাস করত সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। কিন্তু যেদিন আসল সত্য জানা গেল আস্তিকদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। নাস্তিকদের কিন্তু সত্যটা মেনে নিতে কোনও অসুবিধা হয়নি। কারণ নাস্তিকরা বিজ্ঞান মানে। যুক্তি মানে।)
আমার যুক্তি বলছে, নাস্তিক্য প্রচারের নামে যুক্তিহীন কুরুচিকর মন্তব্য করা ঠিক নয়। সবাই তো আর রাতারাতি নাস্তিক হয়ে যাবে না! কেউ যদি ঈশ্বরে বিশ্বাস করেও শান্তিপ্রিয় হন, সবাইকে ভালবাসেন, নিজের ভুল এবং অন্যের গুণ স্বীকার করেন, ক্ষতি কী? যেমন সব্যসাচী কুণ্ডু আস্তিক হয়েও বুঝতে পারছেন ধর্মের নামে অনেক অনাচার হচ্ছে, তিনি নিশ্চয়ই একজন ভালো মানুষ। এই ধরণের আস্তিকদের নিয়ে কোনও সমস্যা নেই। তাঁরা মনে করেন ঈশ্বর আছে। বেশ তো তাঁরা তাঁদের বিশ্বাস নিয়ে থাকুন, আমরা তাঁদের বোঝাব, বুঝিয়েই যাব। বুজিয়ে বললে ১ % হলেও বুঝবেন। গালাগাল দিলে কিছুই বুঝবেন না।
কিন্তু মুশকিল হল সব আস্তিক সব্যসাচীর মত নন। অধিকাংশই নন। ধর্মের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে প্রায় সব ধর্মেই বিধর্মীদের ঘৃণার চোখে দেখা হয় এবং যুদ্ধকে উৎসাহ দেওয়া হয়। ধর্মে ধর্মে তাই জেহাদ, ক্রুসেড, ধর্মযুদ্ধ প্রভৃতি শব্দের ছড়াছড়ি। কেউ বলে একশো বছর প্রার্থনা করার থেকে একদিন যুদ্ধ করা ভালো, কেউ বলে যুদ্ধক্ষেত্রে কাকা, জ্যাঠা, ভাই, গুরু সবাইকে মেরে ফেল। দাবা খেলায় পদাতিক, নৌ, অশ্বারোহী নানান সৈন্য- তার মাঝে হঠাৎই গজের ইংরেজি বিশপ। এর থেকে প্রমান হয় খ্রিস্টানদের সেনাবাহিনির সঙ্গে বিশপরাও যুদ্ধে যেত ধর্ম প্রচারের জন্য।
আসলে ভগবান যদি ১০০ জন অবতার পাঠিয়ে থাকে তাহলে ১০০ লক্ষ শয়তান পাঠিয়েছে। এই ১০০ লক্ষ শয়তান ভগবানের নামেই করে কম্মে খেয়েছে বা খাচ্ছে। আর আস্তিকরা ১০০ জন অবতারের থেকে ১০০ লক্ষ শয়তানের কথা বেশি মান্য করে। ভেবে দেখুন লালনের কজন ভক্ত আর লাদেনের কজন ভক্ত, বিজেপির গঙ্গা সাফাই অভিযানে কজন অংশ নিচ্ছে আর বাবরি মসজিদ ভাঙা অভিযানে কজন অংশ নিয়েছিল। অন্যকে বুকে টেনে নেওয়ার থেকে বুকে ছুরি মারায় আস্তিকদের আগ্রহ একটু বেশিই থাকে। নাস্তিক হলে এই ছুরি মারার সম্ভাবনাটা কমে।
কিন্তু সবাই যদি আপনার মতো আস্তিক হত, যদি সবাই নিজের ধর্মের ভুলটা বুঝত, অন্যের ভালোটা গ্রহণ করত, তা হলে কত ভালই না হত। আস্তিক নাস্তিক তর্কটা চলত। কিন্তু খুন হওয়ার ভয় থাকত না। বরং আপনি আমি যে ভাবে চিঠি লিখছি এই ভাবে শান্তিপূর্ণ বিতর্ক হত।
আজকাল পৃথিবীর যা ছিরি দেখছি, ধর্মের যা ছিরি দেখছি, তাতে আস্তিকদের কাছে শান্তির আশা করতে ভরসা হয় না। তবু বলি, আপনারা আপনাদের ঈশ্বরকে বলুন, ক্ষমতা থাকলে তিনি যেন আগামি দশ বছরের মধ্যে, পশ্চিম এশিয়াকে শান্ত করে দেন, ভারত থেকে জাতপাত লুপ্ত করেন, সবাই যেন নিজের নিজের ধর্ম নিয়ে সুখে থাকে, অন্যের ধর্মকে ভালবাসে, ধর্মের জন্য যে দেশ ভাগ হয়েছে বিনা যুদ্ধে সেই দেশ যেন আবার জুড়ে যায়, এটা যদি ভগবান করে দেখাতে পারেন, আমি মেনে নেব তিনি আছেন, তিনি আছেন।