আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে

পুজো আসে, পুজো চলে যায়। কেনাকাটা থেকে প্রার্থনা, ছবিটা একইরকম থেকে যায়। নানা বয়সের নানা চাহিদা। মেলে ধরলেন মৌতান ঘোষাল

দুর্গাপুজো কী? দেবী দুর্গার আরাধনা, ঊমার পিতৃগৃহে আগমন, শক্তির আরাধনা, শাস্ত্র মতে, পুরাণ মতে আরও অনেক ব্যাখ্যা আছে তার। কিন্তু দুর্গাপুজো মানে কী শুধুই সেই উপাচার? নাকি সহজ ভাষায় আমরা যেমন বলি ‘বাঙালির সব থেকে বড় উৎসব’। সেটুকুই?
না। আসলে দুর্গোৎসব হল একটা ঘটনা, একটা অনুভূতি। বলা ভাল অনেকগুলো ঘটনা, অনেকগুলো ছোট ছোট অনুভূতির নাম দুর্গোৎসব। অনেকে সেই অনুভূতিগুলকে আলাদা আলাদাভাবে টের পান। আবার অনেকে কাছে সবগুল মিলিয়ে এক অনাবিল আনন্দ। বাঙালির এই উৎসবকে বুঝতে গেলে ৪ দিন নয়, অন্ততঃ ৬ টা মাস থাকতে হবে ‘এ বাংলায়’।
বাঙালি’র দুর্গৎসবের শুরু হয় ১ জানুয়ারী থেকে। একটুও বাড়াবড়ি নয়, একদম ঠিক তাই। ইংরাজি বছরের প্রথম দিন ক্যালেণ্ডার হাতে পেয়েই বাঙালির মনে প্রথম যে প্রশ্নটা আসে, ‘এ’বছর দুর্গাপুজো কবে?’ শুরু হয়ে যায় পরিকল্পনা।

shoping4
জুন জুলাই মাস থেকে শুরু হয় এক অংশ বঙ্গ পর্যটকের টিকিট কাটা। পুজোর আউটিং। উত্তর থেকে দক্ষিন বা পশ্চিম সব রুটের ট্রেনের ওয়েটিং লিস্টে চ্যাটার্জি, বোস , ঘোষ, ব্যানার্জি, সাহা ইত্যাদি পদবীর ভিড় নজর কাড়া। এও তো পুজোরই প্রস্তুতি।
এরপর আসে সেলের বাজার, না চৈত্র সেল নয়। এটা নেহাতই আধুনিক ব্র্যাণ্ড সেল। আগস্ট নাগাদ, ব্র্যাণ্ডেড যা কিছু কেনার সুবর্ণ সুযোগ। এই শুরু হয় পুজোর কেনাকাটা, শেষ ষষ্ঠীতে গিয়ে। ব্যতিক্রম থাকতে পারে তবে এ’হিসেব অধিকাংশকে মাথায় রেখে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা টের পেতে শেয়ার বাজার নয় পুজোর বাজার বাঙালির কাছে অনেক বেশি ‘অথেন্টিক’। স্থানীয় বাজারের হকার থেকে মলের রিটেল স্টোর ম্যানেজার বলে দেন ‘বাজার খুব মন্দা দাদা!’
তবু এই মন্দা বাজারেও চলে কেনাকাটা। সাধ্যমতন সাধমতন। পুজো ঠিক কী, তা বুঝতে গেলে কোনও ভিনদেশিকে চড়তে হবে ধর্মতলা থেকে, হাতিবাগান থেকে বা গড়িয়াহাট থেকে আসা কোনও অল্প ভীড়ের বাসে। পরপর ৪ টে সিটে বসা মানুষগুলর চোখেমুখে লেখা পড়তে হবে মনের চোখ দিয়ে। সবে কৈশর পেরোন যে ছেলেদুটো সবে সবে একা বেরিয়েছে বন্ধুর সঙ্গে ‘শপিং’ করতে, বাড়ি থেকে আসা ফোনে ‘বাবু কোথায়? কী কিনলি? টাকা ছিল তো তোর কাছে? ‘ এমন উদ্বিগ্ন প্রশ্নে ঝরে পড়া অস্বস্তির বিরক্তি বলে দেয় পুজো এসেগেছে। অথবা, সেই বাবার চোখমুখ! সদ্য বোনাস পেয়ে স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে পুজোর বাজার সেরে ফেরা তাঁর প্রশান্ত মুখ বলে দেয় পুজো এসে গেছে।
shoping3

এ’সব পেরিয়ে তবে তো আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষন, সেই ৪ দিন! সবথেকে প্রিয় সাজ, বাড়িতে সব থেকে প্রিয় মেনু, সব থেকে প্রিয় সময় কাটানো, সব সেরার সময় বাঙালির পুজো।
আর পুজোর প্রেম? না সে বিষয় নিয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটা লেখা দরকার। নতুন বা একমেবাদ্বিতীয়ম সঙ্গীর হাত ধরে প্যাণ্ডেল হপিং, বা সেই পাড়ার মেয়েটি যাকে প্রোপজ করার রিহার্সাল চলছে গত প্রায় অর্ধেক বছর ধরে, তাকে প্রেম নিবেদনের সঠিক সময় তো এই ৪ দিনই। অষ্টমির সকালে অঞ্জলির সব ফুল কি আর মায়ের পায়ে গিয়ে পড়ে! কত যে অবাধ্য ফুল চোখের কথা মেনে গিয়ে পড়ে ওই লাল শাড়ির সদ্য শ্যাম্পুভেজা চুলে! তা শুধু সে ফুলই জানে।

shoping2
আসলে পুজো আমাদের স্বস্তি। ভেসে যাওয়া। সারাবছর কত না পাওয়া, কত হারিয়ে যাওয়াকে ভুলে যাওয়ার ছুতো দুর্গা পুজো। কত সযত্নে লালিত ক্ষতকে মনে করে ক্যাথারসিসের নাম দুর্গাপুজো। এই ৪ দিন ‘গোলাপি খাম’এর আতঙ্ক ভুলে গোলাপি লিপ্সটিকের মাদকতা। নিত্যদিনের পটলের দর কষাকষি ভুলে বেশি টাকা দিয়ে আধ ভাজা রোল কিনে খাওয়া। পুজো মানে মণ্ডপে ভক্তি ভরে বলা ‘মা বিদ্যে দাও, বুদ্ধি দাও, শক্তি দাও, সাহস দাও। আসছে বছর সব সমস্যা দূর করে দিও মা। ছেলেটা যেন ভালভাবে মাধ্যমিকটা উতরে যায়। মা, ও যেন আমায় হ্যাঁ বলে। মা কেমিস্ট্রিটা উতরে দিও। মা, মেয়েটা যেন পরের বছর তোমায় বরণ করে সিঁদুর খেলতে পারে’। ” মা আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।”

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.