অশোক মডেল যদি হয়, তাহলে মুখ অশোক ভট্টাচার্য নয় কেন?

আলি ইমরান (ভিক্টর)
বিধায়ক, চাকুলিয়া, উত্তর দিনাজপুর

আবার ভেসে উঠছে একটা কথা- অশোক মডেল। কথাটা কে প্রথম বলেছিলেন, জানা নেই। মিডিয়ার বন্ধুরা নিজেদের মতো করে একেকটা নামকরণ করে দেন। সেটাকেই সবার উপর চাপিয়ে দেন।
অশোক ভট্টাচার্যকে যেটুকু চিনি, তিনি নিজে অন্তত নিজের নামে ‘অশোক মডেল’ বলবেন না। প্রথমেই অভিনন্দন জানাই শিলিগুড়ি ও সংলগ্ন এলাকার মানুষকে। তাঁরা বুক চিতিয়ে লড়াই করেছেন। তাঁদের সংগ্রামী চেতনার পরিচয় দিয়েছেন। হুমকি বা প্রলোভন কিন্তু সেখানেও কম ছিল না। বরং, কিছুটা বেশিই ছিল। কারণ, শিলিগুড়ি দখল করতে একেবারে মরিয়া ছিল শাসক দল। আর এই দখল করতে গিয়ে প্রশাসনকে নগ্মভাবে ব্যবহারও করেছে। তাও তারা সফল হয়নি। কারণ, মানুষ প্রতিহত করেছে।
এই প্রচলিত সুরের মাঝে একটু অন্য কথা বলি। শিলিগুড়ির সঙ্গেই নির্বাচন হয়েছিল দিনহাটায়। নিঃসন্দেহে শিলিগুড়ি বড় জায়গা, সেখানকার প্রচার বেশি হবে। কিন্তু দিনহাটার সাফল্যটা যেন একটু বেশিই উপেক্ষিত থেকে গিয়েছিল। এখন উদয়ন গুহ তৃণমূলে নাম লিখিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তিন মাস আগে তাঁকে হারাতে মরিয়া চেষ্টাই চালিয়েছিল তৃণমূল। ষোলটি আসনের মধ্যে তেরোটি পেল বামফ্রন্ট। ফরওয়ার্ড ব্লক একাই পেল দশটি। কিন্তু এই সাফল্যকে সেভাবে তুলে ধরাই হল না। সেখানে কিন্তু কারও সাহায্য ছাড়াই বামফ্রন্ট বোর্ড গড়েছিল। কংগ্রেস বা নির্দলের সাহায্য নিতে হয়নি। দিনহাটা মডেল হল না, মডেল হয়ে গেল শিলিগুড়ি। অন্তত এই একটা ব্যাপারে উদয়ন গুহ-র ক্ষোভ বা অভিমান সঙ্গত। যদিও তাঁর দলত্যাগকে সমর্থন করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।

ashok bhattacharya7

আবার শিলিগুড়ি মডেলে ফিরি। বলা হচ্ছে, যাকে খুশি তাকে দিন, নিজের ভোট নিজে দিন। এই নিয়ে দ্বিমত থাকতে পারে না। যে কোনও গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষই এটা চাইবেন। কিন্তু যেভাবে কংগ্রেস বা বিজেপি-র সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হাঁটার কথা বলা হচ্ছে, সেটা সারা রাজ্যের ক্ষেত্রে কতটা গ্রহণযোগ্য তা ভেবে দেখতে অনুরোধ জানাই। যেখানে কংগ্রেস প্রান্তিক শক্তি, সেখানে তেমন সমস্যা নেই। কিন্তু মালদা, মুর্শিদাবাদ বা আমার জেলা উত্তর দিনাজপুর। এখানে কিন্তু মূল লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গেই। গ্রামে গ্রামে জমির লড়াই থেকে শুরু করে যাবতীয় মেরুকরণ একেবারেই অন্যরকম। সেখানে এই সমীকরণ কতটা কার্যকরী হতে পারে, ভেবে দেখতে পারেন।
তবু যদি মনেই হয়, তৃণমূল বিরোধী শক্তিকে একজোট করবেন, তাহলে শেষমুহূর্তে সেটা উপর থেকে চাপিয়ে দিলে হবে না। নিচুতলা পর্যন্ত প্রবাহিত হতে পারে, সেই পর্যাপ্ত সময়টাও দরকার। বিভিন্ন শরিক দলের সঙ্গে এই নিয়ে এখন থেকেই আলোচনা হওয়া দরকার। তার আগে সিপিএমের নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট হওয়া দরকার। নইলে নিচুতলায় যথেষ্ট বিভ্রান্তি তৈরি হচ্ছে।
এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে আসি। ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, নির্বাচনে একটা মুখকে সামনে রাখা খুব জরুরি। শিলিগুড়ি বা দিনহাটায় কিন্তু মুখকে সামনে রেখেই লড়াই হয়েছিল। সাফল্য আসার এটাও অন্যতম কারণ। সল্টলেকেও অসীম দাশগুপ্তকে সামনে রেখেই লড়াই হয়েছিল।ফল যাই হোক, মুখ সামনে রাখার সিদ্ধান্তটা সঠিক বলেই মনে করি।
ঠিক তেমনি, ২০১৬ তে মুখ কে হবেন, এখন থেকে ভেবে নেওয়া দরকার। অনেক নাম উঠে আসতে পারে। নানা আলোচনায় উঠে আসছেও। উত্তরবঙ্গের এক বাম বিধায়ক হিসেবে আমার প্রস্তাব, অশোক মডেলই যদি অনুসরণ করা হয়, তাহলে অশোক ভট্টাচার্যকে নির্বাচনের মুখ করতে আপত্তি কোথায় ? উত্তরবঙ্গ মানেই বঞ্চনা। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বাম আমলেও উত্তরবঙ্গ বঞ্চিতই ছিল। বারবার এই নিয়ে আমরা সোচ্চারও হয়েছি। প্রশাসন বা সংগঠন, উত্তরবঙ্গ কোথাও প্রাপ্য মর্যাদা পায়নি। সিপিএমের সম্পাদকমণ্ডলীতে এতদিন উত্তরবঙ্গের কেউ ছিলেন না।এতদিনে অশোক ভট্টাচার্যকে নেওয়া হল, তাও আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে। সাতটা জেলা থেকে কাউকে যোগ্য মনে হয়নি?

ashoke bhattacharya8

কলকাতা বা সংলগ্ন এলাকার লোকেরা যে গুরুত্ব পান, উত্তরবঙ্গ কখনই তা পায় না। অথচ, কঠিন পরিস্থিতিতেও শিলিগুড়িই কিন্তু পথ দেখালো। শুধু তৃণমূল বিরোধী হাওয়ায় এই জয় এসেছে, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। অশোক ভট্টাচার্য, জীবেশ সরকাররা সারা বছর লড়াইয়ের ময়দানে ছিলেন। কোনও কর্মী আক্রান্ত হলে সঙ্গে সঙ্গে সেখানে ছুটে গেছেন। নানা সমস্যায়, নানা ইস্যুতে লড়াই করেছেন। শিলিগুড়ি মডেল মানে যেন সরলীকরণ না করে ফেলি। শিলিগুড়ি মডেল মানে কংগ্রেস বা বিজেপি-র সঙ্গে হাত মেলানো নয়। শিলিগুড়ি মডেল মানে হোক, সারাবছর মানুষের পাশে থাকা। অশোক ভট্টাচার্য এই লড়াই থেকে পালিয়ে যাননি। শাসকের সন্ত্রাস বলে অসহায় আক্ষেপ করেননি। কী করে সেই সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করা যায়, সেই শক্তি সঞ্চয় করেছেন।
গত কয়েকমাসে অনেক বাম কর্মীর সঙ্গেও কথা বলে মনে হয়েছে, তাঁরা অশোক ভট্টাচার্যর মতোই মাঠে ময়দানে লড়াই করা কাউকে সামনে দেখতে চান। বুদ্ধদেববাবু শারীরিকভাবে কিছুটা অক্ষম। সূর্যকান্ত মিশ্র সাংগঠনিক দায়িত্বে ক্রমশ ব্যস্ত হয়ে পড়ছেন। তিনি আর নির্বাচনে দাঁড়াবেন বলে মনে হয় না। তাহলে মুখ কে ? পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি দেওয়াই যায়।
উত্তরবঙ্গের মানুষ হিসেবে আমার প্রশ্ন, ‘অশোক মডেল’ই যদি ফলো করতে হয়, তাহলে সেই মডেলের যিনি রূপকার, সেই অশোক ভট্টাচার্যকেই সামনে আনা হোক। গোটা বাংলায় তাঁকে ঘোরানো হোক। প্রশাসক হিসেবেও তিনি যথেষ্ট দক্ষ। আবার সংগঠক হিসেবেও নিজের লড়াই ও দক্ষতার পরিচয় দিয়েছেন। তিনি লড়াইয়ের কথা বললে, তা অনেক মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হবে।
সিপিএম নেতৃত্ব এখন থেকেই ভাবুন।

(সাক্ষাৎকারভিত্তিক অনুলিখন। লেখক পশ্চিমবঙ্গের কনিষ্ঠতম বিধায়ক)।।

(এই ব্যাপারে আপনারাও নিজেদের মতামত জানাতে পারেন। লেখা পাঠাতে পারেন। ঠিকানাঃ bengaltimes.in@gmail.com)

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.