স্বরূপ গোস্বামী
বিধায়ক ছিলেন না। অথচ, এই রাজ্যের মন্ত্রী হয়েছিলেন। গোটা দেশে এমন উদাহরণের অভাব নেই। আইনত বিধায়ক বা সাংসদ না হয়ে মন্ত্রী হতে কোনও বাধাও নেই। শুধু ছমাসের মধ্যে জিতে আসতে হয়। নরসীমা রাও বা দেবগৌড়া যখন দেশের প্রধানমন্ত্রী হন, তাঁরা লোকসভা বা রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন না। পরে উপনির্বাচনে তাঁরা জিতে এসেছিলেন।
আমাদের রাজ্যে মমতা ব্যানার্জি যখন মুখ্যমন্ত্রী হন, তখন তিনি বিধায়ক ছিলেন না। ছিলেন লোকসভার সদস্য ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। পরে ভবানীপুর থেকে উপনির্বাচনে জিতে আসেন। কিন্তু ৩৪ বছরের বাম জমানায় এমন নজির কি আছে? হ্যাঁ, একজনই বিধায়ক না থেকেও মন্ত্রী হয়েছিলেন। তিনি কান্তি বিশ্বাস। যিনি আজ (২৭ এপ্রিল মারা গেলেন)। তাঁর পরিচয় হিসেবে সবাই বলবেন, প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী। কত বছর বয়স হয়েছিল বা কোন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, এসব কথাও কাগজে নিশ্চয় বেরোবে। কিন্তু এই দেশের রাজনীতিতে তিনি এমন একটি ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত, যে কৃতিত্ব বা নজির আর কারও নেই।
না, বিধায়ক না থেকেও মন্ত্রী হওয়ার ব্যাপারে তিনি একমাত্র নন। সারা দেশে এমন উদাহরণ অনেক পাওয়া যাবে। কিন্তু একটি ব্যাপারে তিনিই পথিকৃত। সেই ইতিহাস আর পুনরাবৃত হয়নি। কান্তিবাবু আগেও শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু ১৯৯১ এ গাইঘাটা থেকে তিনি হেরে গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই তিনি মন্ত্রীসভার বাইরে। দু বছরের মাথায় হঠাৎ মন্ত্রীসভা থেকে পদত্যাগ করলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তাঁর শূন্যস্থান পূরণ করতে তথ্য ও সংস্কৃতি মন্ত্রী হিসেবে আনা হল কান্তি বিশ্বাসকে। তিনি তখন বিধায়ক নন। আসলে, তার কয়েকদিন আগেই সন্দেশখালি আসনটি শূন্য হয়। সেখানকার বিধায়ক মারা যান। সেই শূন্য আসনে কান্তি বিশ্বাসকে প্রার্থী করে জিতিয়ে আনার একটা পরিকল্পনা ছিল। সন্দেশখালি তখন নিশ্চিত আসন। জিতে আসা নিয়ে সংশয়ও ছিল না। তাই কান্তিবাবুকে শপথ নেওয়ানো হয়।
কিন্তু আসল গণ্ডগোল বাধল এরপর। তখন দেশের মুখ্য নির্বাচন কমিশনার টি এন শেষন। তিনি তখন গোটা দেশে সচিত্র পরিচয়পত্র চালু করার নাছোড়বান্দা জেদ নিয়ে বসেছেন। সচিত্র পরিচয়পত্র নিয়ে অধিকাংশ দলেরই কোনও আপত্তি ছিল না। কিন্তু শেষনসাহেবের হুকুম, সচিত্র পরিচয়পত্র ছাড়া কোথাও কোনও ভোট হবে না। সন্দেশখালি উপনির্বাচনের দিন ঘোষণা হওয়ার পরেও পিছিয়ে গেল। বামেরা আবেদন করলেন, সাধারণ নির্বাচনের আগে সচিত্র পরিচয়পত্র হোক, আপত্তি নেই। কিন্তু তার জন্য উপনির্বাচন আটকে থাকবে কেন? কিন্তু শেষনসাহেব কর্ণপাত করলেন না। এদিকে কান্তি বিশ্বাসের মন্ত্রীত্বের ছমাস পূর্ণ হতে চলেছে। এবার তাঁকে পদত্যাগ করতে হবে।
তখন সেই মোক্ষম বুদ্ধিটা এসেছিল জ্যোতি বসুর মাথা থেকে। সরকারের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার নির্বাচনের অনুরোধ জানানোর পরেও যখন টি এন শেষন রাজি হলেন না, তখন জ্যোতি বসু আইনের ফাঁক খুঁজে বের করলেন। বলা যায়, অন্যরকমের এত প্রতিবাদ। তিনি ঠিক করলেন, কান্তিবাবুকে পদত্যাগ করাবেন। পরের দিন আবার নতুন করে মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ানো হবে। ঠিক সেটাই হল। আইনে বলা আছে, একবার মন্ত্রী হলে ছমাসের মধ্যে জিতে আসতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয়বার তিনি শপথ নিতে পারবেন না, এমন কথাও সংবিধানে লেখা নেই।
কিন্তু কেন এমন পন্থা নিতে হল ? জ্যোতিবাবুর যুক্তি ছিল, ‘কেউ মারা গেলে ছ’মাসের মধ্যে উপনির্বাচন করতে হয়। এটা নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। কিন্তু নির্বাচন কমিশনার গোঁয়ার্তুমি করছেন। উপনির্বাচন হতে দিচ্ছেন না। তাই বাধ্য হয়েই আমাদের এই পথ নিতে হল।’ যতদূর মনে পড়ে, সারা দেশের সংবিধান বিশারদরা অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সংবিধানের মধ্যেই এমন একটা ফাঁক রয়েছে, তা এর আগে কেউ সেভাবে উপলব্ধিই করেননি। গোটা দেশে এটাকে বলা হল ‘বসু ফর্মুলা’।
পরে অবশ্য সন্দেশখালিতে উপনির্বাচন হয়। কান্তিবাবু বেশ বড় ব্যবধানেই জেতেন। মন্ত্রী থাকতে আর আইনত কোনও বাধা রইল না। বুদ্ধবাবুও মন্ত্রীসভায় ফিরলেন। নিজের পুরানো তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর ফিরে পেলেন। কান্তিবাবু গেলেন নিজের পুরানো দপ্তর, স্কুল শিক্ষায়। ১৯৯৬, ২০০১ এও জিতলেন। ফের স্কুল শিক্ষামন্ত্রী হলেন। ২০০৬ এ আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেননি।
এই রাজ্যে মন্ত্রী অনেকেই ছিলেন। ভোটে না জিতে মন্ত্রী হওয়ার নজিরও রাজ্যে ও দেশে আছে। কিন্তু পদত্যাগ করে পরেরদিন ফের শপথ নেওয়ার অভিনব কাণ্ড দেশে একবারই ঘটেছিল। সেই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কান্তি বিশ্বাসের নাম।
মমতা ব্যানার্জি সম্ভবত এই ইতিহাসের কথা জানেন না। বা সেই সময় জানলেও পরে ভুলে গেছেন। নইলে রেজিনগরে হেরে যাওয়ার পর হুমায়ুন কবীরকে ফের ছ’মাসের জন্য মন্ত্রী বানিয়ে দিতেন। বা পছন্দের কাউকে মন্ত্রী বানিয়ে ছমাস পর পর ফের নতুন করে শপথ নিতে বলতেন। এবার যদি সরকারে আসেন, সেই ফর্মুলা প্রয়োগ করতেই পারেন। সেক্ষেত্রে নাম হয়ে যাবে ‘কান্তি ফর্মুলা’। কী জানি, ‘মমতা ফর্মুলা’ও হয়ে যেতে পারে।