অমিত ভট্টাচার্য
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, নামটা শুনলেই কানে বাজে এক জলদগম্ভীর কন্ঠ। সিংহভাগ মানুষের কাছে যাঁর পরিচয় একজন বাণিজ্যিক ছবির গায়ক এবং প্রথিতযশা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে। মাঝে মাঝে মনে হয়, তাঁর ওই কন্ঠই বোধ হয় তাঁর সবথেকে বেশি ক্ষতি করেছে। অন্তত সুরকার হেমন্ত গায়ক হেমন্তকে দোষারোপ করতেই পারেন। কারণ, গায়ক হেমন্তর কাছে অনেকটাই চাপা পড়ে গেছেন সুরকার হেমন্ত। অথচ, শুধু সুরের জন্যই তিনি অমরত্ব পেতে পারতেন।
১৯৪৭ সালের বাংলা ছবি ‘অভিযাত্রী’ তে সুরকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ। আনন্দমঠ (১৯৫২) তাঁর সুরকার প্রথম হিন্দি ছবি। ১৯৫৪ সালের ছবি ‘নাগিন’ এ সুর করে জীবনের একমাত্র ‘ফিল্মফেয়ার বেস্ট মিউজিক ডিরেক্টর (১৯৫৫)’ এর পুরস্কার পেয়েছিলেন। লতা মঙ্গেশকর এর কন্ঠে ঐ ছবির ‘মন ডোলে মেরা মন ডোলে’ আজও সঙ্গীতপ্রেমী ভারতবাসীর মনকে দোলা দেয়।
হেমন্ত নিজেই জানিয়েছিলেন, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রথাগত শিক্ষা তাঁর ছিল না। অথচ তাঁর সুর শুনে কখনও তেমন মনে হয়নি। তাঁর থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে অনেক বেশি পন্ডিত মানুষ এই দেশে ছিলেন এবং আছেন। কিন্তু হেমন্তের সুর শুনে মনে হয় পান্ডিত্যের থেকে মেধার প্রয়োগ করাটাই অনেক বেশি আন্তরিক। যে কোনও বিষয়কে মাথায় রাখার থেকেও হৃদয়ে স্থান দেওয়া বেশি জরুরি। তাঁর সুর ছিল তাঁর গানের মতোই সোজাসাপ্টা। পাণ্ডিত্য জাহির করার কোনও চেষ্টা নেই। একেবারে সহজিয়া সুর। যা কানের ভেতর দিয়ে মরমে ঠিক পৌঁছে যায়। তার চেয়েও বড় কথা, যার জন্য সুর করা, তাঁর উপযোগী করে গানটা তৈরি করা। কোনটা লতা পারেন, কোনটায় কিশোর বেমানান, কোনটা কার লিপে যাবে, সেই অনুযায়ী গায়ক বা গায়িকাকে বেছে নেওয়া। একটা তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টি না থাকলে যা সম্ভব নয়।
বাংলায় সুরের হাতেখড়ি অভিযাত্রীতে হলেও প্রথম বড় মাপের সাফল্য এল শাপমোচন ছবিতে (১৯৫৫)। তখন তিনি মুম্বইয়েই (তখন বম্বে) বেশি থাকতেন। সেখানে তখন ব্যস্ততা চরমে। ছবিটাতে সুর করার জন্য খুব বেশি সময় পাচ্ছিলেন না। খুব অল্প সময়ে তিনি ‘শোনো বন্ধু শোনো’, ‘সুরের আকাশে তুমি যে গো শুকতারা’, ‘বসে আছি পথ চেয়ে’, ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’ গানগুলোর সুর করেছিলেন। যে গানগুলো বাংলা সঙ্গীতের এক একটা রত্ন! শোনা যায়, মাত্র তিনদিনেই সুর করেছিলেন। রেকর্ড করেছিলেন। গানগুলি তাঁর নিজের একেবারেই ভাল লাগেনি। ঠিক হল না, এই আফশোস নিয়েই বম্বে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু কোন গান কার কখন ভাল লেগে যায়, কে বলতে পারে! ছবিটা তো হিট হলই, গানগুলোও ছড়িয়ে গেল মুখে মুখে। বলা যায়, এখান থেকেই তৈরি হল উত্তম–হেমন্ত জুটি। যার আবেদন উত্তম–সুচিত্রা জুটির থেকে কোনও অংশে কম নয়।
মুম্বইতেও তাঁর সুরের যাদু দেখিয়েছেন। ‘নাগিন’ ছবির কথা আগেই বলা হয়েছে। ‘বিশ সাল বাদ’ ছবির ‘বেকারার করকে হামে’ এবং ‘কহি দ্বীপ জ্বলে’ গান দুটি অমর হয়ে আছে। ‘সাহেব বিবি অউর গোলাম’ ছবিতে গীতা দত্তকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ‘না যাও সাঁইয়া’। এই সুরের মধ্যে ‘অলির কথা শুনে বকুল হাসে’র ছোঁয়া থেকে গেল। ‘এই রাত তোমার আমার’ এর সরাসরি হিন্দি অনুবাদ করলেন ‘কোহরা’ ছবিতে ‘ইয়ে নয়ন ডরে ডরে’। ‘খামোশি’ ছবিতে ‘ও শাম কুছ আজিব থি’তে একদম নতুন ভাবে কিশোর কুমারকে পাওয়া যায়। এই ছবির আর একটি গান ‘তুম পুকার লো’ শুনলে মনে হয়, এত সহজভাবেও গান গাওয়া যায়! অকারণ কালোয়াতি নয়, গলার কেরামতি নয়, সুরের ঢেউ খেলানো নয়। যেন আলতো সুরে সবুজ ঘাসের ওপর হেঁটে যাওয়া।
বাংলা গানের কথা বললে পূজার গান আসবেই। কিশোর কুমারের কন্ঠে কালজয়ী ‘আমার পূজার ফুল’ হেমন্তের এক অমর সৃষ্টি। এখানেও সেই সহজিয়া সুরের স্পর্শ। এতটাই কালজয়ী, এই গানটা এখনও পূজা প্যান্ডেলে বাজে। এই গানটা ছাড়া বাঙালির পূজা একপ্রকার অসম্পূর্ণ।
সবথেকে বড়ো ব্যর্থতা ১৯৭৬ সালে। সেই বছর মহিষাসুরমর্দিনীর বদলে দেবী দুর্গতিহারিণী সম্প্রচার হয়েছিল মহালয়ার ভোরে। মহালয়ায় নতুন জুটি এনে পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন আকাশবাণী কর্তৃপক্ষ। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রর বদলে উত্তমকুমার ছিলেন। সুরের দায়িত্বে ছিলেন হেমন্ত। বাঙালি মহালয়ার ভোরে উত্তম–হেমন্ত জুটিকে গ্রহণ করেনি। আবার সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের মহালয়াই চালাতে হয়েছিল।
অনেকে বলতেই পারেন, কিশোর–লতার গান তো তাঁদের নিজেদের গুণেই জনপ্রিয় হয়। তার পেছনে সুরকারদের কৃতিত্ব কোথায়? কিন্তু তথাকথিত বিখ্যাত নন, এমন অনেকে হেমন্তর সুর করা একটি–দুটি গানের জন্যই স্মরণীয় হয়ে আছেন। কয়েকটা উদাহরণ তুলে ধরা যাক। অমৃক সিং অরোরার কথা বললেই মনেপড়ে ‘রূপসী দোহাই তোমার’। হৈমন্তী শুক্লা বললেই অনেকের মনে ভেসে উঠবে, ‘ওগো বৃষ্টি আমার চোখের পাতা ছুঁয়ো না।’ ঠিক তেমনি অরুন্ধতী হোমচৌধুরির ‘যেতে যেতে কিছু কথা বলব তোমার কানে কানে’ বা ‘যত ভাবনা ছিল, যত স্বপ্ন ছিল’। সুজাতা চক্রবর্তীকে কজন চেনেন? কিন্তু তাঁর গাওয়া ‘ভুল সবই ভুল’ যেন অমরত্ব পেয়ে গেছে। শিবাজি চট্টোপাধ্যায় যে অনুষ্ঠানেই যান, তাঁকে ‘খোঁপার ওই গোলাপ দিয়ে’, ‘এ ছন্দ, এ আনন্দ’ বা সেই বিখ্যাত গান ‘অভাগা যেদিকে চায়’ গাইতেই হয়। এর বাইরে শিবাজির অন্য কোন গানটা আপনার মনে আছে! এগুলো কয়েকটি উদাহরণমাত্র। চাইলে তালিকাটা অনেক লম্বা হতে পারে।
বলা হয়, তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই রবীন্দ্র সঙ্গীত। কিন্তু যেসব ছবিগুলোর কথা বলা যায়, তার সঙ্গীত পরিচালকের নাম কিন্তু হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। ছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের ব্যবহার এতটাই সুন্দর হয়েছে, অনেকে সেই ছবির গান বলেই মনে করেন। ‘চরণ ধরিতে দিও’ বেজে উঠলে অনেকেই বলে ওঠেন এটা দাদার কীর্তির গান। বা ‘তোমার কাছে এ বর মাগি’ গাইলেই অনেকে বলে ওঠেন, এটা ভালবাসা ভালবাসার গান। আসলে, গানগুলো শুনলে মনে হয়, প্রচলিত রবীন্দ্র ঘরানা থেকে অন্যরকম, একেবারে প্রাণবন্ত। এভাবেই রবি ঠাকুরের কত গান পৌঁছে গেছে সিনেমার হাত ধরে।
যাঁরা শুধু সুরকার, তাঁদের ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকম। সলিল চৌধুরি, নচিকেতা ঘোষ বা সুধীন দাশগুপ্তরা নিজেরা গান গাইতেন না। ফলে, ভাল সুরগুলো কাউকে না কাউকে দিতেই হত। কিন্তু হেমন্তর ক্ষেত্রে বিষয়টা অন্যরকম। তিনি নিজে গাইতে পারতেন, অথচ মহান সৃষ্টি হাসতে হাসতে তুলে দিচ্ছেন অন্যের হাতে। একই ছবিতে তিনি গেয়েছেন ‘তুম পুকার লো’। সেই ছবিতেই সেরা গানটা (ও সাম কুছ আজিব থি) তুলে দিয়েছেন কিশোর কুমারের কণ্ঠে। দারুণ সুর, হিট অবশ্যম্ভাবী জেনেও ‘আমার পূজার ফুল’ বা ‘সে যেন আমার কাছে’ তুলে রাখছেন অন্য গায়কের জন্য।
শুধু ভাল সুর করলেই হয় না। নিজে দুরন্ত কণ্ঠের অধিকারী হয়েও সেরা সুরটা অন্যের হাতে তুলে দেওয়া! অনেক চওড়া হৃদয় লাগে। এখানেই গায়ক হেমন্তকে কোথাও কোথাও ছাপিয়ে গেছেন সুরকার হেমন্ত।