সংহিতা বারুই
দুই বাংলা বলতে আমরা শুরুতেই ধরে নিই, এপার বাংলা–ওপার বাংলা। মানে, পশ্চিমবঙ্গ আর বাংলাদেশ। কিন্তু আমাদের এই বিভাজনটা পূর্ব আর পশ্চিমে নয়। বলতে পারেন, উত্তর আর দক্ষিণে। বিভাজনই বা বলি কী করে? বরং বলা যায়, উত্তরবঙ্গ আর দক্ষিণবঙ্গের মেলবন্ধন।
উজানের টানে। একটি স্বপ্নের নাম। বিদেশি অনুদান তো দূরের কথা। কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারেরও কোনও অনুদান নেই। কোনও কর্পোরেট সংস্থা বা বড় ব্যবসায়ীরাও নেই। কোনও মিডিয়া হাউসও নেই। আসলে, অন্যদের পাশে দাঁড়ানোর অঙ্গীকার নিয়ে ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর একটা সৎ প্রচেষ্টা।
বড় বড় কাজ করার মতো সামর্থ্য আমাদের নেই। সমাজ বদলে ফেলার ইউটোপিয়ান ভাবনাও নেই। আমরা ছোট ছোট উদ্যোগে কিছু মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করি। প্রান্তিক মানুষের মুখে একটু হাসি ফোটাতে পারি। বনের মোষ তাড়ানোর পারিশ্রমিক হিসেবে বলতে পারেন এটুকুই আমাদের প্রাপ্তি।
আমাদের এই দলটা খুব বড় নয়। সিদ্ধার্থ দাস, দিগন্ত সরকারদের সঙ্গে আমিও জুটেছি। মূলত বিভিন্ন চেনাজানা লোকেদের কাছ থেকে পুরনো কাপড়–জামা, শীতবস্ত্র চেয়ে প্রান্তিক মানুষের মধ্যে বিলি করা। এভাবেই শুরু। প্রত্যেকেরই নিজের নিজের কাজ থাকা। তাই, আমরা কেউ হোলটাইমার নই। রোজ হয়ত এই কাজ করতেও পারতাম না। তবে মাঝে মাঝে জামা–কাপড় জোগাড় করে দূরে কোথাও চলে যাওয়ার আনন্দটাই আলাদা। বেশ কয়েকবার গেছি পুরুলিয়ায়। এবারও ঘুরে এলাম। মাঠা ১ নম্বর অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি। মধুপুর, মানবেরা, সোনাকুপি, পারডি। অযোধ্যা পাহাড় লাগোয়া এমনই সব গ্রাম। প্রকৃতিও কিছুটা রুক্ষ। উন্নয়নের ঢক্কা নিনাদ থাকলেও বাস্তব ছবিটা মোটেই তেমন নয়। সেখানকার মানুষের হাতে কাপড়, জামা, লুঙ্গি, প্যান্ট এসব তুলে দিতে পেরে বেশ ভালই লেগেছে। এসব এলাকা অবশ্য আমাদের অচেনা নয়। আগেও কয়েকবার গেছি।
এবার পাড়ি দিয়েছিলাম উত্তরবঙ্গের দিকে। যাই যাই শীত। কিন্তু এত বড় উত্তরবঙ্গে কোথায় যাব? বেছে নেওয়া হল কিছু বন্ধ চা–বাগান এলাকাকে। রতন দাস, স্বপ্না দাস, নিতাই দাসরা এগিয়ে এলেন। নকশালবাড়ির কাছেই ডাকুয়াজোগ, লেমুভিতা, ছলছলিয়া, ফকিরাযোগ, মাঞ্জা টি এস্টেট এলাকায় চলল আমাদের অভিযান। গত কয়েক বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে পুরনো জামাকাপড় দিয়ে আসছি। বিভিন্ন সহৃদয় মানুষের কাছে নানাভাবে এই বার্তা পৌঁছেও গেছে। ফলে, এখন অনেকে নতুন কাপড় দিয়ে সাহায্য করতে চাইছেন। সবাই যে চেনা, এমনও নয়। অনেক অচেনা মানুষও ফোন করেন। নতুন জামাকাপড় পৌঁছে দিয়ে যান। অনেক দোকানদারও দোকানে জমা হয়ে থাকা জামাকাপড় আমাদের দিয়ে যান। তাই এবারও গাড়ি বোঝাই করা সেই সব জামাকাপড়, শাড়ি, লুঙ্গি, শীতবস্ত্রের সম্ভার নিয়ে গিয়েছিলাম। এমনকী কিছু রেনকোটও জোগাড় হয়েছিল। সেইসব বন্ধ চা–বাগানের শ্রমিকদের মধ্যেও বেশ উন্মাদনা দেখা গেল। আমরা কোথায় তাঁদের সন্ধান পেলাম, কেনই বা দিতে এলাম, তাঁরাও যেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। কেউ কেউ হয়ত ভাবছিলেন, ভোটের আগে হয়ত নাম কেনার চেষ্টা। কিন্তু যখন বোঝালাম, আমরা শিলিগুড়ি বা জলপাইগুড়ি থেকে আসিনি, আমাদের এই আসার সঙ্গে ভোটের কোনও সম্পর্ক নেই, তখন তাঁরাও বুঝলেন।
বন্ধ চা–বাগানে নানা সমস্যা ভীড় করে আছে। সরকারি সাহায্য কতটুকু পৌঁছয়, তাঁরাই জানেন। আমাদের এই চেষ্টা হয়ত নিতান্তই সামান্য। ওঁদের দৈনন্দিন লড়াই ওঁদেরই লড়তে হবে। তবু, একটা দিনের জন্য হলেও ওই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়াতে পারলাম। এ প্রাপ্তিও কম নয়।