বয়কট দিয়ে গেলেন আস্ত একটা নদী

স্বরূপ গোস্বামী

সম্পর্কের শুরুটা সেই ৪৪ বছর আগে। জিওফ্রে বয়কট তখন কিংবদন্তি। ঠিক আগের টেস্টেই স্যর গ্যারি সোবার্সের সর্বাধিক রানের রেকর্ড ছাপিয়ে এসেছেন। টেস্ট ক্রিকেটে তিনিই তখন সবথেকে বেশি রানের মালিক। এসেছেন ইডেনে টেস্ট খেলতে। প্র‌্যাকটিসে হাজির আনকোরা এক তরুণ। নাক উঁচু সাহেব জানতে চাইলেন, কী চাই? সদ্য ভূমিষ্ঠ হওয়া কাগজের‌ একুশের নাছোড়বান্দা তরুণ আমতা আমতা করে বললেন, ‘‌ইন্টারভিউ’‌। কী ভেবে কী জানি, বয়কট রাজি হয়ে গেলেন। ডেকে নিলেন গ্র‌্যান্ডে।

সেই শুরু। কিন্তু এই শুরু আসলে কিছুই নয়। তখন অধিনায়ক কিথ ফ্লেচারের সঙ্গে কোনও একটা কারণে তাঁর বিবাদ চরমে। ইডেন টেস্ট চলাকালীন একুশের সেই ছোকরাকে নিয়ে তিনি সোজা চলে গেলেন টালিগঞ্জ গল্‌ফ ক্লাবে। সতীর্থরা ইডেনে, আর তিনি কিনা গল্‌ফ ক্লাবে!‌ সেখান থেকেই তরুণ সাংবাদিককে নিয়ে সোজা চলে গেলেন বিমানবন্দরে। কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে একা একাই দেশে ফেরার বিমানে উঠে পড়লেন। ক্রিক ইনফোর পরিসংখ্যান বলছে, সেটাই ছিল তাঁর জীবনের শেষ টেস্ট। তরুণ সাংবাদিক চেয়েছিলেন নিছক একটা ইন্টারভিউ। আর কিংবদন্তি বয়কট কিনা দিয়ে গেলেন আস্ত একটা ‘‌ওয়ার্ল্ড এক্সক্লুসিভ’‌। চেয়েছিলেন এক গ্লাস জল, তিনি দিয়ে গেলেন আস্ত একটা নদী।

সেদিনের সেই তরুণের চুলেও কবেই পাক ধরেছে। তিনিও সিনিয়র সিটিজেনের তকমা পেয়েছেন বেশ কয়েক বছর হয়ে গেল। সম্পর্কের সেই নদীটা এখনও একইভাবে বয়ে চলেছে। এখনও নিয়ম করে ফোনাফুনি, মেসেজ বিনিময় চলে। দুজনে দুজনকে এতটাই চেনেন, অনেক স্বামী–‌স্ত্রীও একে অন্যকে এতখানি চেনেন কিনা সন্দেহ। একজন তো কিংবদন্তি বয়কট। অন্যজন কে, তা নিয়ে আর ধোঁয়াশা না রাখাই ভাল। তিনি দেবাশিস দত্ত। ৪৪ বছরে দেবাশিস দত্তর বইয়ের সংখ্যা বহুকাল আগে একশো ছাপিয়ে গেছে। কিন্তু বয়কটকে নিয়ে বই এই প্রথম। কখনও বইয়ের বিষয় গাভাসকার, কখনও শচীন, কখনও সৌরভ। হাসিমুখে সেইসব বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছেন বয়কট। মাঝে মাঝেই খুনসুটি করতেন, আমাকে দিয়ে কি শুধু ভূমিকাই লেখাবে!‌ আমাকে নিয়ে বইটা কবে হবে?‌ অবশেষে, হয়েই গেল। এই বইয়ের ভূমিকা তো আর বয়কটকে দিয়ে লেখানো যায় না। লিখেছেন আরেক কিংবদন্তি, ক্লাইভ লয়েড। বয়কট কি নিছক একজন সাহেব!‌ প্রথম টেস্টেই যিনি সৌরভকে দেখে বলে বসলেন ‘‌প্রিন্স অফ কালকুটা’‌, তিনি নিজের অজান্তেই হয়ে উঠেছে বাঙালির আপনজন।

এই বই মোটেই ইয়র্কশায়ারের ‘‌চিরতরুণ’‌ বয়কটের জীবনী নয়। নেট ঘেঁটে তুলে আনা বহুচর্চিত ঘটনার সংকলনও নয়। তাহলে এই বইয়ে আছেটা কী?‌ প্রথম দুই অনুচ্ছেদ থেকে তার কিছুটা আভাস নিশ্চয় পাওয়া যাচ্ছে। ৪৪ বছরের নিবিঢ় বন্ধুত্বের পর যে বইয়ের জন্ম হয়, তার দুই মলাটের ভেতর কী থাকতে পারে, নিজেরাই ভেবে নিন। আমাদের কুয়োর জীবনে হঠাৎ করেই যেন মহাসমুদ্রের হাতছানি। সাঁতার দিতে দিতে অতল গভীরে পৌঁছে যাওয়া। যেখানে অন্তত স‌বজান্তা গুগল বাবাজীবনের প্রবেশাধিকার নেই।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.