প্রশান্ত বসু
খেলোয়াড়দের আত্মজীবনী নিয়ে একটা মজার গল্প আছে। একজন ক্রিকেটারের আত্মজীবনী বেরিয়েছে। একসময়ের সতীর্থ এক ক্রিকেটার জানতে চাইলেন, ‘তোর তো বই বেরিয়েছে। বেশ ভালই হয়েছে। একটা কথা বলবি, কে লিখে দিল?’
যাঁর বই বেরিয়েছে, তিনিও কম রসিক নন। তিনিও পাল্টা গুগলি ছুড়ে দিলেন, ‘আমার পক্ষে যে এতবড় বই লেখা সম্ভব নয়, এটা সবাই জানে। কে লিখেছে, তার নামটা তোকে বলতেই পারি। কিন্তু তার আগে তোকে বলতে হবে, বইটা তোকে কে পড়ে শোনাল। কারণ, আমি জানি এটা পড়া তোর কম্ম নয়।’
খেলোয়াড়দের কাজ খেলা। তিনি গুছিয়ে লিখতে পারবেন, এমনটা না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তাই বলে তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতার কোনও মূল্য নেই? তাঁর ছেলেবেলা, তাঁর বেড়ে ওঠা, তাঁর লড়াই— এগুলোর মূল্য নেই? তাই তাঁর জীবনের কথা যদি অন্য কেউ লিখেও দেন, এতে অন্যায়ের কিছু নেই। এবং এটা স্বীকার করতে কুণ্ঠা থাকারও কথা নয়।
সাক্ষী মালিকের সেই কুণ্ঠা নেই। তিনি অকপটেই জানিয়েছেন, কে তাঁর হয়ে বইটি লিখে দিয়েছেন। এবং একেবারে প্রচ্ছদেই রয়েছে সেই সহ লেখকের নাম। বইয়ের নাম ‘উইটনেস’। নামটির মধ্যে আলাদা এক ব্যঞ্জনা আছে। উইটনেস মানে সাক্ষী। অর্থাৎ, একদিকে এটা যেমন সাক্ষী মালিকের অনুমোদিত আত্মজীবনী, কিন্তু বইয়ের প্রচ্ছদে নিজের নাম ব্যবহার করেননি। আবার সাক্ষী অনেক ঘটনার সাক্ষী। সেই ভাষ্য এক সমকালীন ইতিহাসকে আরও কিছুটা চিনিয়ে দিয়ে যায়।
একজন মহিলা কুস্তিকে বেছে নিচ্ছেন, আজকের দিনে এটা ভাবা কিছুটা সহজ হলেও সাক্ষী যখন বেড়ে উঠছেন, তখন ততখানি সহজ ছিল না। পুরুষশাসিত সমাজের নানা ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে কুস্তির আখড়ায় যাওয়ার চ্যালেঞ্জটা নিতে হয়েছে সেদিনের কিশোরীকে। একের পর এক বাধা টপকে কিনা পৌঁছে গেলেন অলিম্পিক পোডিয়ামে। তার আগে সুশীল কুমার বা যোগোশ্বর দত্তরা অলিম্পিকের আসর থেকে পদক এনেছেন ঠিকই, কিন্তু মেয়েদের কুস্তিতে সেই ইতিহাস নির্মাণ করেছিলেন সাক্ষীই।
সতীর্থদের যেমন কাছ থেকে দেখেছেন, তেমনই দেখেছেন কর্তাদেরও। কুস্তি জগতের আলো আঁধারি দিক তাঁর মতো করে দেখেছেন। অকপটে সেসব কথা লিখেওছেন। ব্রিজভূষণ শরণ সিং মানুষটি আসলে কেমন, কেন খেলোয়াড়রা একযোগে তাঁর অপসারণ চাইছিলেন, সেসব কথা বিরাট অংশজুড়ে আছে। নিজে কীভাবে ব্রিজভূষণের দ্বারা নির্যাতিত হয়েছেন, সে কথা লিখতেও কোনও কুণ্ঠা দেখাননি। এমনকী কৈশোরে আত্মীয়দের দ্বারাও যে এমন ছোটখাটো লাঞ্ছনা জুটেছে, সেকথাও অকপটেই লিখেছেন।
কুস্তি ফেডারেশনের বিরুদ্ধে লাগাতার ধর্নার কথা তো আছেই। সেই ধর্না থেকে নিজের পদক যেমন নদীতে ভাসাতে গিয়েছিলেন, তেমনই অকালেই অবসরও ঘোষণা করেন। কেন মাঝপথে থমকে গেল আন্দোলন, ভেতরে ভেতরে কারা অন্য অঙ্ক কষছিলেন, সেই প্রসঙ্গও উঠে এসেছে গভীর আক্ষেপের সঙ্গে। যেমন ববিতা ফোগাট সম্পর্কে খোলাখুলিই লিখেছেন, ‘আমাদের আন্দোলনের জন্য উস্কে দিয়েছিল ববিতা। কিন্তু নিজে ধর্নায় বসল না। কারণ, ধর্নায় বসলে বিজেপি ওর ওপর চটে যেতে পারে। ও চেয়েছিল, আমরা আন্দোলন করে ব্রিজভূষণকে সরিয়ে দেব। আর সেই ফাঁকা চেয়ারে ও বসে পড়বে। আমাদের তাতেও আপত্তি ছিল না। ব্রিজভূষণের বদলে অন্তত একজন খেলোয়াড় তো বসবে।’
বিনেশ ফোগাট কেন ট্রায়াল ছাড়া অলিম্পিকে গেলেন, তা নিয়ে আক্ষেপ যেমন আছে, তেমনই সেই বিনেশ যে ফাইনালে পৌঁছেছেন, সেই গর্ববোধও আছে। একশো গ্রাম ওজন বেশি হওয়ায় বিনেশের ছিটকে যাওয়ায় আক্ষেপ আছে, কিন্তু তিনি অন্তত এর পেছনে কোনও চক্রান্ত দেখছেন না, এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন। ব্যক্তিগত কিছু বিষয়ও উঠে এসেছে। যেমন, তাঁর বিয়ের প্রসঙ্গ। একসময় তাঁদের সম্পর্কে পরিবারের কোনও আপত্তি ছিল না। হঠাৎ, সাক্ষী অলিম্পিক পদক পেতেই পরিবারের অনেকে বেঁকে বসলেন। তাঁরা আরও ভাল পাত্র খুঁজতে লাগলেন। এখানেও বেঁকে বসলেন সাক্ষী, বিয়ে করলে তাকেই করব। অন্য কাউকে নয়।
এমন অনেক অজানা ঘটনা। যা খেলার মাঠের আড়ালে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাকে চিনিয়ে দিয়ে যায়। সাক্ষীর পথ চলার পাশাপাশি সেই সময় ও সতীর্থদেরও চেনা যায়। এই দেশে কুস্তির বিবর্তনের ইতিহাসটাও কোথাও একটা ধরা পড়ে। তাই কে লিখে দিলেন, বা কে পড়ে দিলেন, এই বিতর্ক থাক। এই জাতীয় বই আরও লেখা হোক। এই বইগুলোই তো দলিল হয়ে থেকে যাবে।