স্বরূপ গোস্বামী
দিনটা ছিল ১৫ আগস্ট। না, তখন এই তারিখের সঙ্গে ভারতের স্বাধীনতার কোনও সম্পর্ক ছিল না। কারণ, সালটা ছিল ১৯৩৬। অর্থাৎ, স্বাধীনতার ৯ বছর আগে।
কী ঘটেছিল সেই ১৫ আগস্টে? বার্লিন অলিম্পিকে হকির ফাইনালে জার্মানির সামনে ভারত। আগের দু’বারের চ্যাম্পিয়ন ভারত। হ্যাটট্রিকের সামনে দাঁড়িয়ে। অন্যদিকে, জার্মানি খেলছে ঘরের মাঠে। গ্যালারিতে অন্তত ২৫ হাজার দর্শক। তার থেকেও বড় কথা, গ্যালারিতে জার্মানির জয় দেখতে হাজির স্বয়ং হিটলার। নিজেকে আরও সর্বশক্তিমান হিসেবে তুলে ধরতে বেছে নিয়েছিলেন অলিম্পিকের মঞ্চকেই।
সেই হিটলারের সামনে জার্মানির এমন বেইজ্জতি! আসলে, অলিম্পিক শুরুর আগে একটি প্রস্তুতি ম্যাচে জার্মানির কাছে হারতে হয়েছিল ভারতকে। তাই হিটলার হয়ত ধরে নিয়েছিলেন, ফাইনালেও তারই পুনরাবৃত্তি হবে। প্রথমার্ধে রূপ সিংয়ের গোলে এগিয়ে গেল ভারত। হিটলার তখনও ভাবছেন, এক গোল আর কী এমন ব্যাপার। দ্বিতীয়ার্ধে ওটা শোধ হয়ে যাবে। কিন্তু দ্বিতীয়ার্ধ যে এত ঘটনাবহুল হবে, কে জানত! স্কোরলাইন বলছে, সেই ম্যাচের ফল হয়েছিল ৮–১। এটা আসলে কিছুই নয়। তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটেছিল, যা স্কোরলাইনে লেখা নেই। এক, ধ্যানচাঁদ দেখলেন, জুতো পায়ে ঠিক খেলা যাচ্ছে না। জুতো খুলে খেললেন খালি পায়ে। ধ্যানচাঁদ নিজেই করলেন তিন খানা গোল। ভারতের জয় তখন নিশ্চিত। দুই, ধ্যানচাঁদকে আহত করতে চাইলেন জার্মান গোলকিপার। হকির জাদুকরের দাঁতই ভেঙে গেল। তিন, ভারতীয় শিবির তখন উত্তপ্ত। তাঁরা ঠিক করে নিয়েছেন, মাঠে এর উপযুক্ত জবাব দেবেন। কিন্তু ধ্যানচাঁদ বললেন, এটা আমাদের রাস্তা নয়। ভারতীয় হকি কী জিনিস, ওদের এবার দেখিয়ে দেব। একের পর এক জার্মান খেলোয়াড়দের কাটিয়ে ডি–এর মধ্যে ঢুকে যাচ্ছেন। সামনে ফাঁকা গোল। কিন্তু গোল না করে ব্যাক পাস করছেন। বেশ কয়েকবার এমন জার্মান ডিফেন্সকে নিয়ে এমন ছেলেখেলা করলেন। স্বয়ং হিটলারের সামনে।
পরদিন, অর্থাৎ ১৬ আগস্ট আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল। কিন্তু তার আগে পনেরোই আগস্টেরই আরও একটা ছোট্ট ঘটনা তুলে ধরা যাক। তখনও ভারতের আলাদা কোনও পতাকা ছিল না। ইউনিয়ন জ্যাক প্রতীক নিয়েই নামতে হত। কিন্তু দলের ম্যানেজার পঙ্কজ গুপ্ত পকেটে একটা তেরঙা পতাকা নিয়ে গিয়েছিলেন। সেটা ছিল কংগ্রেসের পতাকা। অশোক চক্রের বদলে মাঝে ছিল চরকা। ম্যাচের আগে সাজঘরে বের করলেন সেই তেরঙা। সেই পতাকা সামনে রেখেই শপথ নিয়েছিলেন ধ্যানচাঁদরা। হকির জাদুকর সতীর্থদের বলেছিলেন, এই পতাকার সম্মান রাখতেই হবে। যেভাবেই হোক, আজ জার্মানিকে হারাতেই হবে।
এবার ১৬ আগস্টে আসাই যায়। ফাইনালে নিজের দেশের এমন বেইজ্জতি দেখে হিটলারের মনের অবস্থা কী, সহজেই অনুমেয়। পরদিন তিনি ধ্যানচাঁদকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানালেন। সেই আমন্ত্রণকে সম্মান জানিয়ে ধ্যানচাঁদ দেখা করতে গেলেন। একথা–সেকথার পর হিটলার জানতে চাইলেন, ভারতের সেনাবাহিনীতে কোন পদে চাকরি করেন? কত মাইনে পান? ধ্যানচাঁদ জানালেন, তিনি সেনাবাহিনীর নায়েক। ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাঠামো হিটলারের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তবু তিনি এটুকু বুঝলেন, ধ্যানচাঁদ খুব একটা উচ্চপদস্থ নন। তখন হিটলার ফেললেন সেই মোক্ষম তাস — ‘আপনি এমন একজন খেলোয়াড়, দেশকে এত গৌরব এনে দিচ্ছেন, আর আপনাকে এত নিচু পোস্টে চাকরি করতে হয়! আপনি আমাদের সেনাবাহিনীতে যোগ দিন। অনেক উচ্চপদে নিয়োগ করা হবে। অনেক বেশি মাইনে হবে।’ এমন একটা অঙ্কের কথা বললেন, যা শুনে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ারই কথা।
কিন্তু ধ্যানচাঁদ শান্ত কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আমার দেশ আমাকে যেটুকু দিয়েছে, আমি তাতেই খুশি। দেশ আমাকে কী দিল, সেটা আমার কাছে বড় নয়। আমি দেশকে কী দিতে চাই, সেটাই বড় কথা। আমার মনে হয়, আমার এখনও দেশকে অনেককিছু দেওয়ার আছে।’ হিটলারের এমন প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু ধ্যানচাঁদ পেরেছিলেন। অথচ, ফিরে এসে যে একলাফে বিরাট পদোন্নতি হয়েছিল, এমনও নয়। বছর দুই পরে হয়েছিলেন সুবেদার, তারও বছর পাঁচ পর লেফটেনেন্ট, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্যাপ্টেন। তারপর বিদায় নিয়েছেন মেজর হিসেবে। সেই কারণেই ‘মেজর ধ্যানচাদ’ বলেই এখন তাঁকে সম্বোধন করা হয়। কিন্তু এই ‘মেজর’ হয়েছিলেন একেবারে বিদায়বেলায় এসে। দেশকে অলিম্পিকে তিন খানা সোনা দেওয়ারও প্রায় দুই দশক পর।
এবার আরও পিছনে হাঁটা যাক। সময়টা ১৯২৬। তখন তিনি সেনাবাহিনীর মামুলি সিপাই। হঠাৎ ঘুম থেকে তুলে বলা হল, নিউজিল্যান্ডে যেতে হবে। ধ্যানচাঁদ তো শুরুতে বিশ্বাসও করেননি। পরে জানলেন, সত্যিই যেতে হবে। মাদ্রাজ থেকে কলম্বো হয়ে দল পাড়ি দিল নিউজিল্যান্ডে। সেটাই ছিল ধ্যানচাঁদের প্রথম বিদেশ সফর। সেবার ২১ ম্যাচে ১৮ জয় পেয়েছিল ভারত। ধ্যানচাঁদ একাই করলেন শতাধিক গোল। কিন্তু ফিরে আসার পর তাঁকে রেজিমেন্টের কাজে জুড়ে দেওয়া হল। হকি নিয়ে কোনও উচ্চবাচ্য নেই। হকি থেকে অনেকটাই যেন দূরে সরে গেলেন ধ্যানচাঁদ। কারণও ছিল। ১৯২৪–এর প্যারিস অলিম্পিকে হকি ছেঁটে ফেলা হয়েছিল। অলিম্পিকে আবার হকিকে ফিরিয়ে আনার পেছনে ভারতের বিরাট অবদান। ১৯২৮–এর আমস্টার্ডামে আবার ফিরে এল হকি। কিন্তু দল পাঠানোর তো অনেক খরচ। কে দেবে এত টাকা? তাই যাওয়াটাই অনিশ্চিত হয়ে গেল। শেষমেষ জট কাটল। অস্ট্রিয়া, বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ডকে দাপটের সঙ্গে হারিয়ে ফাইনালে সামনে আয়োজক হল্যান্ড। এদিকে, ধ্যানচাঁদের ১০৩ ডিগ্রি জ্বর। খেলার মতো অবস্থায় নেই। দলের ম্যানেজার বললেন, ‘এই অবস্থায় তোমার খেলা ঠিক হবে না। খুব ঝুঁকি হয়ে যাবে।’ সেদিন ধ্যানচাঁদের উত্তর ছিল, ‘স্যার, আমি সেনাবাহিনীর সিপাই। যে কোনও পরিস্থিতিতে যুদ্ধ করতে তৈরি। আর আজ জ্বর হয়েছে বলে খেলা থেকে পালিয়ে যাব?’ খেলেছিলেন। অলিম্পিকে দেশকে প্রথম সোনা এনে দিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানেও বিপত্তি। বলের ওপর হকি স্টিকের এমন নিয়ন্ত্রণ কী করে হয়! সন্দেহ হল, হকি স্টিকে চুম্বক লাগানো নেই তো? সন্দেহতেই বিষয়টা থেমে থাকল না। হকি স্টিক ভেঙে নিশ্চিত হওয়া গেল, চুম্বক নেই।
আচ্ছা, ১৯২৮ এর আগে হকিতে কারা চ্যাম্পিয়ন হত? পরিসংখ্যান বলছে, তার আগে অলিম্পিকে দু’বার হকি হয়েছিল (১৯০৮, ১৯২০)। দুবারই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল ইংল্যান্ড। তাহলে, ১৯২৮ সালে ইংল্যান্ডের কী হল? ঘটনা হল, ভারতের দাপট দেখে শেষমুহূর্তে ইংল্যান্ড নাম তুলে নিয়েছিল। কারণ, তাঁদের অধীনস্থ দেশ ভারতের কাছে তারা হারতে চায়নি। আর আমস্টার্ডামে ধ্যানচাঁদের জাদু দেখার পর লস এঞ্জেলেস (১৯৩২) ও বার্লিনেও (১৯৩৬) দল পাঠানোর ঝুঁকি নেয়নি। যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, সেই প্রবল পরাক্রমশালী ব্রিটিশও বোধ হয় ভারতীয় সেনার সামান্য এক সিপাইকে কোথাও একটা ভয় পেয়েছিল। নইলে, অন্যান্য খেলায় অংশ নিলেও হকি থেকে পালিয়ে গেল কেন?