ছোট্ট একটি মেয়ে। হাতছানি দিয়ে ডাকছে পাহাড়। আপাতত সে এইচএমআইয়ে। সামনের মাসেই তার ট্রেকিংয়ের ঠিকানা সাতোপন্থ। আরও কত বাধার পাহাড় দাঁড়িয়ে। তেমনই এক পর্বতারোহীকে নিয়ে লিখলেন বন্দনা সিনহা।।
জীবনে পাহাড়ের কি বিরাম আছে? একটা পাহাড় জয় করার পর সামনে এসে হাজির হয়ে যায় অন্য এক পাহাড়। সেখানে চড়লেও নিষ্কৃতি নেই। কী জানি, সামনে কোন পাহাড় দাঁড়িয়ে আছে!
পাহাড় মানে শুধু সেই ছেলেবেলার ভূগোল বইয়ে পড়া সমতল থেকে অনেকটা উঁচু ভূমি নয়। এই পাহাড় যেন প্রতীকি। কোনও বাধার পাহাড়। কোনওটা দারিদ্র্যের পাহাড়। কোনওটা সামাজিক শিকলের পাহাড়। কোনওটা আবার ভয়ের পাহাড়। একটা টপকাতে গেলেন, তো অন্যটা ঠিক হাজির হয়ে যাবে। তবু ওদের লড়াই চলতে থাকে। এই সমস্যাগুলো যেন ওদের জেদ বাড়িয়ে দেয়। পায়ের তলায় অনেক বাধার প্রাচীর টপকে ওরা মাথু তুলে দাঁড়ায়।
যার কথা লিখছি, সে এই কলকাতা শহরেরই কোনও এক বস্তিতে বেড়ে ওঠা এক মেয়ে। ছোট থেকে জন্মসূত্রেই পেয়েছে দারিদ্র্য। মেয়েটির নাম শ্রেয়া ঠাকুর। বাবা গৌতম ঠাকুর। মা মিনা ঠাকুর অন্যের বাড়িতে পরিচারিকার কাজ করেন। এমন দারিদ্র্যের মধ্যে বেঁচে থাকাটাই এক বড় সংগ্রাম। পাহাড়ে ওঠা তো অনেক দূরের ব্যাপার। কিন্তু কেউ কেউ থাকে, যারা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার রাস্তা ঠিক খুঁজে নেয়। শ্রেয়া তেমনই এক লড়াকু মেয়ে।
জন্ম ২০০১ সালে, নারকেলডাঙ্গার মারোয়াড়ি বাগান বস্তি এলাকায়। আর্থিক কারণেই লেখাপড়া সেভাবে হয়ে ওঠেনি। ভর্তি হল একটি কম্পিউটার অ্যাকাডেমিতে। সেখানে কোনও খরচ লাগত না। ঘটনাচক্রে সেখানকার যিনি মাস্টারমশাই, তিনি পাহাড়ে ওঠার তালিম দিয়ে থাকেন। ছোট্ট স্নেহার মনে হল, সেও যদি পাহাড়ে উঠতে পারত! একটু একটু করে শুরু হল পাহাড়ে ওঠার প্রশিক্ষণ। পীযূষ সিনহার তত্বাবধানে নারকেলডাঙ্গা ট্রেকার্স অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে শুরু হল অভিযান। পূর্বাঞ্চলীয় পর্বারোহনে নাম লিখিয়ে দুটি ইভেন্টে প্রথম, একটিতে দ্বিতীয়। এবার পাড়ি দিল দিল্লিতে। সেখানে মেয়ের সাহসিকতা ও পরিশ্রমের তারিফ করলেন অনেকেই। এদিকে, অভাবের সংসার। এই অবস্থায় পর্বতারোহন তো একধরনের বিলাসিতাই। পাশে দাঁড়ালেন পীযূষ স্যার ও স্থানীয় ক্রীড়াদরদী অমূল্য সেন। ২০১৬ তে মেয়ে পাড়ি দিল ভাগীরথী মিটে। কিন্তু মন্দ আবহাওয়া। তাই অন্য সবার মতো তাকেও ফিরে আসতে হয়েছে। ছোটখাটো পাহাড় তো জয় হয়ে গিয়েছে, কিন্তু একটু উঁচুতে উঠলেই তো বরফের হাতছানি। সেখানে ট্রেকিং তো আরও শক্ত। দুর্ঘটনার আশঙ্কাও থেকেই যায়। বরফে ট্রেকিং কীভাবে হবে? শিখে নিলেন পীযূষ স্যারের কাছে।
এবার এসেছে আরও বড় সুযোগ। ডাক এসেছে তেনজিং নোরগের হাতে তৈরি হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউট থেকে। সেখানে পৌঁছেও গিয়েছে তরুণী শ্রেয়া। আপাতত কয়েকদিন তার ঠিকানা দার্জিলিং। জুনের শুরুতেই রয়েছে সাতোপন্থ অভিযান। বরফে মোড়া এই ট্রেকিং রুটে যাওয়া বেশ দুঃসাহসিক ব্যাপার। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে। এতবড় অভিযান, কেই বা পাশে থাকার বার্তা দিয়ে এগিয়ে আসবে? আমরা কি পারি না এই মেয়েটির লড়াইয়ের পাশে থাকতে? আমরা অনেকে চাইলেও আর পাহাড়ে উঠতে পারব না। কিন্তু যে পারছে, তার পাশে যদি একটু দাঁড়াতে পারতাম! পাহাড় নিজের মতোই দাঁড়িয়ে থাকে। তার সাধ্য কি এই মেয়ের লড়াই থামিয়ে দেবে!