বই তো আছে, ফোন কেন?‌

কয়েকমাস আগের কথা। উচ্চমাধ্যমিকে রাজ্যে প্রথম হওয়া ছাত্র মোক্ষম প্রশ্নটি তুলে দিল। তোমার হাতে বই আছে। তাহলে মোবাইল কেন?‌

আপাতভাবে প্রশ্নটি খুব নিরীহ। কিন্তু বিরাট এক ব্যঞ্জনা লুকিয়ে আছে প্রশ্নটির মধ্যে। সত্যিই তো, বই থাকলে ফোনের কী দরকার?‌ কিন্তু এই প্রজন্ম ভাবতে শিখেছে একটু উল্টোভাবে। তাঁদের প্রশ্ন, ফোন থাকলে বইয়ের কী দরকার?‌

স্মার্টফোন নামক বস্তুটি কতখানি আশীর্বাদ আর কতখানি অভিশাপ, এ নিয়ে প্রশ্ন তোলাই যায়। এর উপকারী দিকের তালিকা দিতে গেলে শেষ হবে না। কিন্তু অপকারী দিকগুলো যেন নিঃশব্দে মারণরোগের মতো হানা দিচ্ছে। যা আমরা বুঝতে পারছি না। কিন্তু আমাদের চিন্তা, চেতনার জগৎকে একেবারে দেউলিয়া করে তুলছে।

আমরা কি সত্যিই এখন আর বই পড়তে পারি?‌ অনেকে বলবেন, সময় পাই না। অজুহাত হিসেবে ভাল। কিন্তু বাস্তবতা অন্যরকম। আসলে, বই পড়তে গেলে যে ধৈর্য লাগে, যে সহিষ্ণুতা লাগে, তা আমরা হারিয়ে ফেলেছি। আমরা এখন টানা দু’‌পাতা পড়তেই ভুলে গেছি। আরও ভাল ভাবে বলতে গেলে, টানা দশ মিনিট ফোন ছাড়া থাকতেই ভুলে গেছি। স্মার্টফোন আসক্ত কোনও কিশোর বা তরুণের কাছ থেকে দশ মিনিটের জন্য শুধু একবার ফোনটা চেয়ে নিন। তারপর তার অবস্থা দেখুন। মাছকে ডাঙ্গায় কিছুক্ষণ রেখে দিলে সে যেমন ছটফট করে, এই ছেলেদেরও তেমনভাবেই ছটফট করতে দেখা যাবে। সে বাথরুম যাওয়ার সময়টুকুও ফোন ছাড়া থাকতে পারে না। বাসেও তার ফোন চাই। ট্রেনে ঝুলতে ঝুলতেও তার ফোন চাই। দুজন পাশাপাশি বসে। কিন্তু কেউ কারও সঙ্গে কোনও কথা বলছে না। কেউ কারও কথা শুনছে না। দুজনেরই মন পড়ে আছে সেই ফোনেই। আমরা যেমন পড়তে ভুলে গেছি। আমরা শুনতেও ভুলে গেছি। পড়া আর শোনা, এই দুই মিলেই তো পড়াশোনা। এই দুটো অভ্যাসই যে আমরা হারিয়ে ফেলেছি।

একটা বিরাট অংশের বাবা–‌মা বিশ্বাস করেন, ফোন হাতে তাঁদের ছেলেমেয়েরা হয়তো পড়াশোনাই করছে। হয়তো অনলাইনে কোনও ক্লাস করছে। এটা ভেবে তাঁরা বেশ শ্লাঘা অনুভব করেন। কিন্তু তার মন যে ক্লাসে বা পড়াশোনায় নেই, নিঃশব্দে অন্য কোথায় পাড়ি দিয়েছে, অভিভাবকেরা বুঝতেও পারেন না। সারাদিন কতক্ষণ সময় আমাদের বইয়ের সঙ্গে কাটে আর কতক্ষণ সময় ফোনের সঙ্গে কাটে, তার একটা পরিসংখ্যান থাকলে ছবিটা আরও পরিষ্কার হত। দেখা যাবে, ফোন হাতে হয়তো দশ ঘণ্টা কাটছে। যার মধ্যে পড়াশোনার জন্য বরাদ্দ হয়তো দশ মিনিটও নয়। এমনকী যে সময়টায় তার হাতে ফোন নেই, তখনও মনটা কিন্তু সেই ফোনেই আছে।

কী অদ্ভুত এক নিঃশব্দ মহামারি হানা দিয়েছে। এই মায়াজাল থেকে মুক্তির রাস্তা কী?‌ সত্যিই জানা নেই।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.